১৯৭১সালের সেই ভয়াল বিভৎস দিনটি স্মরণ করিয়ে দিতে আবারো ফিরে এলো ১৩ই সেপ্টম্বর। আজকের এই দিনে সাপাহার উপজেলার বেশ কয়েকজন স্বাধীনতাকামী বীর মুক্তি যোদ্ধা পাক-সেনাদের শক্তিশালী ক্যাম্প উৎখাত করে ছিলেন। পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে সাপাহারবাসীকে মুক্ত করতে গিয়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন বীর বাঙ্গালী মুক্তি সেনার দল। সে দিনের সেই সম্মুখ যুদ্ধে বেশ কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত ও আহত হয়ে ছিলেন। তাই প্রতি বছর এই দিনটি ফিরে এলেই অনেক সন্তান হারা মা, পিতা হারা সন্তান ও স্বজনগণ শহীদদের কথা স্মরণ করে নিরবে চোখের পানি ফেলেন।
এলাকাবাসী ও প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট থেকে জানা যায়। ১৯৭১সালে দেশে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হলে দেশের অন্যান্য এলাকার মত তৎকালীন স্বাধীনতা বিরোধী ও রাজাকারদের সহযোগীতায় সাপাহার উপজেলাও পাকিস্তানী বাহিনীর দখলে চলে যায়। বর্তমান উপজেলা সদরের পাইলট উচ্চবিদ্যালয় এলাকায় সে সময় তারা তাদের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলে একটি শক্তিশালী ক্যাম্প আর এই ক্যাম্পের নেত্বত্ব দেন পাকিস্তানী বাহিনীর লে: কর্নেল মীর শওকত আলী। এখান থেকেই তারা প্রতি দিন এলাকার চিহিৃত রাজাকারদের দেয়া নির্দেশ মত বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে সাধারণ নিরিহ মানুষের ধনসম্পদ লুট,পাট মা বোনদের ইজ্জত হরন করে এলাকায় এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েক করে। যুদ্ধের প্রায় ৬মাস অতিবাহিত হলে সেপ্টম্বর মাসে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মত অবস্থায় পাকিস্তানী বাহিনীর দ্বারা নির্যাতনের স্বীকার সাপাহারবাসীকে মুক্ত করতে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ সংকল্প করেন। পাকহানাদার বাহিনীর সেই শক্তিশালী ক্যাম্পটিকে উৎখাত করতে সাপাহার ও পার্শ্ববর্তী মহাদেবপুর উপজেলার প্রায় ৮০জন বীর মুক্তি যোদ্ধার একটি দল সংঘবদ্ধ হয়। তৎকালীন পাকিস্থাী মিলিটারী বাহিনীর লে: কর্নেল মীর শওকত আলীর নের্তৃত্বে সু-সজ্জিত ওই ক্যাম্পটিকে সরিয়ে ফেলার জন্য তারা এক গোপন বৈঠকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। আজকের এই দিনে ১৩সেপ্টম্ব রাতে বীর মুক্তিযোদ্ধার সজ্জিত ওই দলটি তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি উপ দলকে সাপাহার-মধইল রাস্তার মধইল ব্রিজে বাহিরের শত্রুদের গতি বিধি দেখার জন্য রাখা হয়। আর একটি দলকে চারিদিকের অবস্থা পর্যবেক্ষনে সারাক্ষন টহলে রাখা হয় এবং মুল দলটি ওই বিদ্যালয়ের উত্তর পূর্ব দিকে একটি ধান ক্ষেতে অবস্থান নেয়।
ঠিক এ সময় দেশের রাজাকার আলবদর মারফত মুক্তি যোদ্ধাদের আক্রমণ প্রস্তুতির সংবাদ পৌঁছে যায় শত্রু শিবিরে তাৎক্ষনিক তারাও যুদ্ধের প্রস্ততি গ্রহন করে। অব শেষে অপেক্ষার প্রহর শেষে ভোর রাতে আক্রমণ চালায় ধান ক্ষেতে অবস্থান নেয়া মুল দলটি, পাইলট মাঠ থেকে শত্রু সেনারাও পাল্টা আক্রমণ চালাতে শুরু করে। প্রায় ঘন্টাকাল ব্যাপী এক টানা যুদ্ধের পর মু্িক্তযোদ্ধা আইয়ুব আলী পাকবাহিনীর অধিনায়ক লে: কর্নেল মীর শওকত আলীকে নিহত করে মুক্তি যোদ্ধার দলটি যখন পাক সেনাদের প্রায় কোন ঠাসা করে ফেলেছিল ঠিক তখনই ভোরের আভাস পেয়ে মধইল ব্রীজে অবস্থান নেয়া মুক্তি যোদ্ধার উপ দলটি সেখান থেকে সরে পড়ে আর সে মহুর্তে পতœীতলা উপজেলা সদর ও মধইল বাজার এলাকা থেকে অসংখ্য পাক সেনারা অত্যাধুনিক অস্ত্র স্বস্ত্র নিয়ে সাপাহারে প্রবেশ করে।
নতুন করে শত্রু সেনার অনুপ্রবেশে শত্রুবাহিনীর শক্তি দ্বীগুন হারে বেড়ে যায় এবং তারা একসময় স্বল্পসংখ্যক মুক্তি যোদ্ধার দলটিকে ধরাশায়ী করে ফেলে। এ সময় শত্রু সেনার তাজা বুলেটের গুলির আঘাতে যুদ্ধের মাঠেই শাহাদাত বরণ করেন মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান, আইয়ুব আলী, আবদুল হামিদ সহ প্রায় ১৫জন। আহত হন মুক্তিযোদ্ধা মনছুর আলী, এস এম জাহিদুল ইসলাম, দলনেতা আহম্মদ উল্লাহ, সোহরাব হোসেন, নুরুল ইসলাম সহ অনেকে। এ ছাড়া শত্রুদের হাতে জীবিত ধরা পড়েন ৮জন। এ সময় শত্রু সেনারা যুদ্ধের মাঠ থেকে সাপাহারের তিলনা গ্রামের আবু ওয়াহেদ গেটের, মহাদেবপুর উপজেলার এসএম জাহিদুল ইসলাম সহ ৮জন মুক্তি যোদ্ধাকে ধরে এনে মধইল স্কুলের ছাদে তুলে ৪ জনকে কুপিয়ে হত্যার পর লাশ গুলো লাথি মেরে ছাঁদ থেকে মাটিতে ফেলে দেয়। অপর ২জনকে মহাদেবপুর এনে একটি কুপে ফেলে দিয়ে জীবন্ত কবর দেয়। আবুওয়াহেদ গেটের ও এসএম জাহিদুল ইসলামকে ধরে এনে নাটোর জেলা সদরে তৎকালিন তাদের তৈরীকৃত রাজবাড়ীর জেলখানায় বন্দী রাখে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম জাহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের নিকট সেদিনের সেই নারকীয় ঘটনার বর্ননা দিয়ে ছিলেন। আজকের এই দিনের কথা স্মরণ করে অনেকে অঝোরে তাদের চোখের পানি ফেলেন। নিরবে ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন।
উল্লেখ্য যে, প্রতিবছর দিনটি ঘুরে এলেও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের পক্ষ থেকে শহীদদের স্মরণে কোন স্মরণ সভা বা কর্মসূচি গ্রহণ করা না হলেও সাপাহার উপজেলার সাংবাদিকগন তাদের স্ব-স্ব পত্র পত্রিকায় লিখে সেই যুদ্ধে শহীদ ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান স্মরণ করে থাকেন।