পেয়ারার রাজ্য খ্যাত আটঘর-কুড়িয়ানা এবং পাশ্ববর্তী জিন্দাকাঠী, আদমকাঠি, ধলহার, রাজাপুর, মাহামুদকাঠি প্রভ’তি। এসব গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে পেয়ারা বাগানগুলোতে করোনার প্রভাবে তেমন একটা ফলন ভাল হয়নি। যেসব গাছে ফলন হয়েছে সেগুলোর অর্ধেকই ছিটপড়া রোগে আক্রান্ত। তার পরেও করোনায়ও থেমে নেই পেয়ারা চাষীরা। জিন্দাকাঠি গ্রামের পেয়ারার প্রবীণ চাষী চিত্র রঞ্জণ জানান, কুড়িয়ানাকে পেয়ারার রাজ্য বলা হলেও পাশ্ববর্তী বরিশালের বানারীপাড়া এবং ঝালকাঠি সদর উপজেলায় পেয়ারা চাষের বিস্তৃতি এ বছরও ঘটেছে। যার কারণে প্রতিবছরের মত এ বছরের করোনাও পেয়ারার জলবাজারের সৌন্দর্য এখনোও সেই ভিয়েতনামের মতই। জলের উপর পণ্যে বেচা-কেনা, কেউ বলেন জলবাজার কেউ বা ভাসমান বাজার। তবে শত বছরের পুরনো এ জলবাজার হঠাৎ করে দেখলে মনে হতে পারে থাইল্যন্ড, ব্যাংকক ও ভিয়েতনাম জলবাজারের চেয়েও অধিক অনাবদ্য আর ঐতিহ্যের্যের। জলবাজারের এ সৌন্দর্য্যরে সাথে যোগ হয়েছে দৈনন্দিক নিত্যপণ্যসহ মৌসুমের নানান ফল বেচা-কেনা। বিশেষ করে বাগান থেকে তরতাজা পেয়ারাগুলো ডিঙি ও পানসি নৌকায় এ মৌসুমে প্রতিদিনের ভাসমান বাজারে পেয়ায়ার সমরহর জন্য পেয়ারার বাজারের নাম ডাকটা পরিচিতি দেশঝুড়ে। ঐতিহ্যবাহী বরিশালের বানারীপড়া, পিরোজপুরের স্বরুপকাঠি ও ঝালকাঠির ভিমরুলীর সন্ধ্যা নদীর শাখা খালে ছোট-ছোট ডিঙি নৌকার দৃষ্টিনন্ধিত পেয়ায়ার ভাসমান বাজার দেখে যেকেউর মনে হতে পারে জলের সাথে জলযান আর জলজীবনের এখানকার মানুষের রাতফোটা বেচে থাকার বাজার।
বরিশালের তিনটি জেলার ৮৬টি গ্রামে ৮৫৮ হেক্টর জমিতে প্রায় ৩ হাজার ২২০ পেয়ারার বাগান রয়েছে। এর মধ্যে ৬৫৭ হেক্টর জমিতে ২০২৫টি পেয়ারার বাগান পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদেই। দেশের অধিকাংশ পেয়ারা বাগান এ উপজেলাতে গড়ে উঠায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নেছারাবাদকে(স্বরুপকাঠি) পেয়ারার ফলনের রাজ্য বলা হয়। ব্যাপক ফলনে এ সারা দেশের চাহিদা মিঠিয়ে বাংলার আপেল নামে পরিচিত নেছারাবাদের (স্বরুপকাঠি) পেয়ারা রিসাইক্লিং করে উন্নতমানের জেলি তৈরির কাঁচামাল হিসেবে বিশ্বের ৯টি দেশ পর্তুগাল, মালয়শিয়া, মেক্সিকো, কলম্বিয়া, ভারত, মায়ানমার, ব্রাজিল, পাকিস্তান ও মালয়েশিয়া রফতানি হচ্ছে। এছাড়াও পেয়ারার পাতা থেকে ডায়েবেটিসের চা তৈরীর এ পাতা ২টি দেশে রফতানি হচ্ছে। এখানকার পেয়ারা বিদেশে জেলি তৈরির কাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সংশ্লিষ্ট অফিস সূত্র অনুযায়ী, পিরোজপুরের এক মাত্র পেয়ারা উৎপাদনকারী অঞ্চল নেছারাবাদে বছরে প্রায় ১৬ লাখ মন পেয়ারা চাষ হয়, যার মুল্য প্রায় ৬০ কোটি টাকা। এর অধিকাংশ টাকাই বিদেশে রফতানি থেকে আসছে। নেছারাবাদে ২০২৫টি বাগানে প্রায় সাড়ে আট হাজার পেয়ারা চাষী এতে শ্রম দিয়ে আর্থিক ভাবে স্ববলম্বী হয়েছে।
যাপান ও দক্ষিণকরিয়ায় পেয়ারার পাতা রি-ফ্রেস ও রিসাইক্লিং করে এক প্রকার চা তৈরি করা হয় যা মানবদেহের ডায়েবেটিস রোগীদের জন্য খুবই উপকারি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পেয়ারা পাতার চা জনপ্রিয় হয়ে উঠায় বিশ্ববাজারে পেয়ারার পাতার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
নেছারাবাদে (স্বরুপকাঠি) দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর পেয়ারা আষাঢ, শ্রাবণ ও ভাদ্রর এ তিন মাস রাসায়নিক সার ছাড়াই ভাসমান বাজারে পেয়ারার বেচাকেনার হিড়িক পড়ে। পেয়ারার চাষ ও ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ২৪টি পেয়ারার আড়তের মধ্যে উল্লেযোগ্য আড়ত আটগড়, কুড়িয়ানা, ভিমরুলী, ডুমুরিয়া, শতদশকাঠি ও বাউকাঠি। ভীমরুলি, শতদকাঠি ও জগদীশপুর এই ৩টি খালের মহনায় এসব আড়তগুলো নেছারাবাদে(স্বরুপকাঠিতে) অবাস্থিত। পাইকারী দরে এসব আড়ত থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাজারজাত করার পর সেগুলো আবার অধুনিক পর্যায়ে প্যাকেটজাত হয়ে বর্হিরবিশ্বে রফতানি করা হয়।
পেয়ারা চাষী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহর মন্ডল বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর পেয়ারার ফলন প্রায় ৩৫ ভাগ কম হয়েছে।
এসব চাষীদের অর্থ উপার্জনের একমাত্র পথ পেয়ারা চাষের ওপর নির্ভরশীল। তবে চাষীরা বলছে এবার করোনার কারণে ক্ষয়-ক্ষতিটা অনেক বেশী হয়েছে। সরকারের আর্থিক সহায়তায় পেলে এ ক্ষতিপূরণ পুশিয়ে উঠা সম্বাব হবে বলে চাষীরা জানান। সরকারের আর্থিক সহায়তা ছাড়া এ ক্ষতিপূরণ পুশিয়ে উঠতে তাদের অনেকটা কষ্ট হবে।
স্বরুপকাঠি কৃষি বিভাগ সূত্র জানান, কুড়িয়ানাসহ আশ পাশের গ্রামগুলোতে ৮৫০ হেক্টর জমিতি ২ হাজার ৫৫টি বাগানে পেয়ারার চাষ হয়েছে। প্রত্যক্ষ-পরক্ষভাবে প্রায় আড়াই হাজার পরিবার এ পেয়ারা চাষে জড়িত থেকে জীনব-জীবিকা উপর্জন করছেন। কিন্তু বৈরি আবহাওয়ার আর করনোর কারণে এ বছর ফলন কিছুটা কম হওয়ায় চাষীদের মনে আনন্দ নেই।