এবার হলুদ, মরিচ ও ধনিয়ার মত রান্নায় ব্যবহার হবে পেঁয়াজের পাউডার (গুড়া)। শুনতে অবাক লাগলেও খুব অস্বাভাবিক বিষয় নয়; বরং কাঁচার চেয়ে গুড়া বেশি সাশ্রয়ী। সংরক্ষণও করা যাবে দীর্ঘদিন। এতে দেশে পেঁয়াজ আমদানির ওপর চাপ কমবে সেই সাথে অর্থনীতির নতুন দ্বার উন্মোচন হবে।
সম্ভাবনার কথাগুলো শুনিয়েছেন বগুড়ার শিবগঞ্জে অবস্থিত মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানী ড. মো. মাসুদ আলম। খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্পর্কিত গবেষণা করতে গিয়ে তার পেঁয়াজের পাউডার উদ্ভাবনে আগ্রহ জন্মে। পেঁয়াজের পাউডার এখন বাজারজাত করার পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান এই কৃষি বিজ্ঞানী।
মসলা গবেষণা কেন্দ্রের এই গবেষক জানিয়েছেন, পেঁয়াজ পচনশীল হওয়ার কারণে বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। তবে পেঁয়াজের পাউডার দুই বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। পাউডার প্রক্রিয়াজাতকরণ করে দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ পেঁয়াজের পচন রোধ করাও সম্ভব।
২০০৯ সালের দিকে পেঁয়াজের পাউডার প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি নিয়ে কাজ শুরু করেন মসলা গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মাসুদ। সফলতা আসতে তার সময় লেগেছে ৫ বছর। তার দাবি, এর প্রক্রিয়াজাতকরণও খুব সাধারণ হওয়ায় যে কেউ ঘরেই বসেই পেঁয়াজের পাউডার তৈরি করতে পারবেন। তার দেখানো পদ্ধিতিতে পেঁয়াজের পাউডার বানিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা সম্ভব। যান্ত্রিকভাবে শুকিয়ে করলে সময় লাগবে সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টা আর প্রাকৃতিকভাবে করলে বাড়তি কিছুদিন সময় লাগবে।
তার দেওয়া তথ্যমতে, মাঠ থেকে সংগৃহীত হয়ে খাদ্যে ব্যবহার করার আগে পেঁয়াজের প্রায় ৩০ শতাংশই পচে যায়। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের ক্ষেত্রে এই সংরক্ষণ ক্ষতির হার আরও বেশি; প্রায় ৭০-৮০ শতাংশই পচনের কবলে পড়ে।
৪-৬ জনের একটি পরিবারে মাসে গড়ে ৫ কেজি পেঁয়াজ লাগে। এ হিসাবে একটি পরিবারে বছরে পেঁয়াজের মোট চাহিদা গড়ে ৬০ কেজি। তবে ৬০ কেজি পেঁয়াজ কোনো পরিবারের চাহিদা থাকলে বাজার থেকে কিনতে হয় ৮০ কেজির মতো। কারণ পেঁয়াজ কিনে রাখলে পচে যায়। কিন্তু পেঁয়াজ পাউডার করে রাখলে পড়ার কোনো আশঙ্কা নেই। পাউডার বা গুড়া করে ভালভাবে সংরক্ষণ করলে তা থাকবে প্রায় দু বছর। আর পেঁয়াজ প্রক্রিয়াজাতকরণে গুড়া করলে এর গুণগত মান, খাদ্যে ব্যবহারের পরিমাণ কোনোটাই কমে না। এক কেজি পেঁয়াজ শুকিয়ে পাউডার পাওয়া যায় ১০০ থেকে ২০০ গ্রাম।
এই বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যায় মাসুদ জানান, একটি পরিবারে এক কেজি মাংস রান্না করতে সাধারণত কাঁচা পেঁয়াজ লাগে ২৫০ গ্রাম। আর এই ২৫০ গ্রাম পেঁয়াজ পাউডার করলে পাওয়া যাবে ২৫ গ্রাম। মাংস রান্নাতে ওই ২৫ গ্রাম পাউডার দিলেই হবে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে কাঁচা পেঁয়াজের চেয়ে রান্নায় পাউডারে খরচও বেশি নয়।
কৃষি গবেষক বলেন, জাপান, চীন, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বহু দেশেই এ ধরনের প্রকিয়াজাতকরণ খাদ্য বা মসলার ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ কোম্পানি পণ্য তৈরিতে এসব পাউডার ব্যবহার করা হয়। এ হিসেবে উদ্যোক্তারা দেশে পেঁয়াজের পাউডারের বাজার তৈরি করলে ব্যাপক আয়ের সম্ভবনা রয়েছে।
ইতোমধ্যে প্রাণ কোম্পানির প্রতিনিধি, সিলেটসহ দেশের অনেক জেলা থেকে একাধিক ব্যক্তি বগুড়ায় এসে ড. মাসুদের এই উদ্ভাবন দেখে গেছেন। এর মধ্যে সিলেটের দুজন ব্যক্তি পেঁয়াজের পাউডার প্রক্রিয়াজাতকরণ শুরু করেছেন বলে জানান মাসুদ।
মসলা গবেষণা কেন্দ্রর দেওয়া তথ্য মতে, বছরে দেশে মোট পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৩৫ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে দেশীয় উৎপাদন ২৩ দশমিক ৭৬ লাখ মেট্রিক টন। আর বাকি ১১ লাখ থেকে ১২ লাখ মেট্রিক টন আমদানি করতে হয়। তবে পেঁয়াজের পাউডার পদ্ধতিতে আমদানি ব্যয় কমবে। এতে সাশ্রয়ী হবে রাষ্ট্রীয় অর্থ।
ড. মাসুদের পেঁয়াজ পাউডার পদ্ধতিকে পুরোপুরি সমর্থন করে গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হামীম রেজা বলেন, দেশে সব ধরনের মসলাই আমদানি নির্ভর। এজন্য আমরা যত এর চাষ ও বাজারজাতকরণ বৃদ্ধি করতে পারব; ততই লাভ। ড. মাসুদের তৈরি পেঁয়াজের গুড়া পদ্ধতি যুগান্তকারী উদ্ভাবন। এটি বানিজ্যিকভাবে যদি নাও কার যায় ঘরোয়াভাবে করলেও লাভ। এতেও দেশে পেঁয়াজের আমদানির দৌড়াত্ম কমবে।
হামীম আরও বলেন, তবে উদ্যোক্তাদের ব্যবসা শুরু করতে হলে আমাদের সাথে সমঝোতা স্বাক্ষর চুক্তি (এমওইউ) করতে হবে। কারণ এই গবেষণা আমাদের তথা রাষ্ট্রের। এমওইউ থাকলে আমরাও বিভিন্ন সময়ে তাদের দিকনির্দেশনা দিতে পারব।
পেঁয়াজের গুড়া বা পাউডার সূর্যের তাপে ও যান্ত্রিক পদ্ধতি দুভাবেই করা যায়। দুটোতেই খরচ খুবই সীমিত। এই প্রক্রিয়াজাত কাজে প্রয়োজন পেঁয়াজ কাঁটার যন্ত্র (সøাইসার), প্লাস্টিকের পাত্র, লবণ, সোডিয়াম মেটা বাইসালফাইড, ড্রায়ার মেশিন (শুকানোর যন্ত্র), পলি ব্যাগ। কয়েকটি ধাপে কাজগুলো শেষ হয়।
প্রথমে পেঁয়াজ সংগ্রহ করে বাছাই করতে হয়। বাছাই করা পেঁয়াজ পরিস্কার করে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে। পরে সেগুলো সøাইস করে কেটে নিয়ে ভাপ দিতে হয়। ভাপ দেয়া হলে পেঁয়াজগুলো সোডিয়াম মেটা বাইসালফাইড দ্রবণে ডুবিয়ে রাখতে হবে। এরপরের ধাপে পেঁয়াজ শুকাতে হয়। শুকিয়ে গেলে সেগুলো ব্লেংডিং (গুড়া) করলেই কাজ শেষ। এখন এই গুড়া মোড়কে ভরে সংরক্ষণ করুন অথবা বাজারজাতকরণ করতে হবে।