কোভিড ১৯ মূলত চীনের উহান প্রদেশ থেকে শুরু হয়। গত বৎসরের মার্চ মাস থেকে এর সংক্রমণ যা একবৎসর হয়েছে তবে এখন উহানের করোনা দাপট এখন কিছুটা কম। এখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ সহ এশিয়া আফ্রিকা ছড়িয়ে বিশে^র সবকটি দেশে আক্রান্ত হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশ একটি ঘণবসতিপূর্ণ এলাকা তাই এর সংক্রমণও বেড়ে চলেছে। প্রায় এককোটি বাংলাদেশী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে।
তা সত্তে¦ও বাংলাদেশের মানুষ অন্যান্য দেশের তুলনায় আক্রান্তের সংখ্যা কম। বলা যায় বাংলাদেশ সরকার সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। যদিও ২য় পর্যায় অতিক্রম করছে বাংলাদেশ তাই এর ঝুকিটা মনে হচ্ছে কমে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ এর সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সচেতনতা, মানুষ একটু সচেতন হলেই এর প্রাদুর্ভাব থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে হারে এর সংক্রমণ বাড়ছে তাতে অতি সহজেই এর থেকে মুক্তি মিলছে না। আক্রান্তের সংখ্যা এককোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং মৃত্যুর সংখ্যাতো সহজেই অনুমেয়। যদিও উহানে লক ডাউন উঠিয়ে দেয়া হয়েছে কিন্তু তারপরও এর আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুর সংখ্যাও থামছে না। তাহলে কোভিড-১৯ কি চলতেই থাকবে, এর শেষ কোথায়। এর মধ্যে জাপানীর বিজ্ঞানীরা এর সংক্রমণের একটি দিক আবিষ্কার করে ফেলেছেন সেটি হচ্ছে, মাইক্রো ড্রপলেটস বা ক্ষুদ্্র ফোটা যার মাধ্যমে ঘুড়ে বেড়ায় অসংখ্য ক্ষুৃদ্র ক্ষুদ্র ফোটা যা বাতাসের মধ্যে অনেকক্ষণ জীবীত থাকে। যে বা যারা হাচি বা কাশির মাধ্যমে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোটা ছেড়ে দেয়। এবং সেখান থেকে কোন মানুষ আক্রান্ত হতে পারে।
করোনা ভাইরাস যেভাবে আমাদের চিন্তাভাবনার জগৎ দখল করে ফেলেছে, এর আগে তেমনটা অন্য কোনো রোগের ক্ষেত্রে হয়নি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিটি সংবাদমাধ্যম রেডিও, টেলিভিশন জুড়ে করোনা ভাইরাস-সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত, পরামর্শ, গুজব ইত্যাদি। একই সঙ্গে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির খবরে মানসিক উদ্বেগ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে; স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়ছে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। করোনা ভাইরাস নিয়ে অব্যাহত ভীতি মানুষের মানসিকতার ওপর ফেলতে পারে বিরূপ প্রভাব। করোনা-ভীতিতে মানুষের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আসতে পারে। বিশেষ করে সামাজিক মেলামেশা, বিচারক্ষমতা আরো বেশি রক্ষণশীল হয়ে উঠতে পারে।
অভিবাসন, যৌন স্বাধীনতা ও সমতা নিয়ে মানুষের ভাবনার পরিবর্তন আসতে পারে। এমনকি আমাদের রাজনৈতিক মতাদর্শেও পরিবর্তন ঘটাতে পারে করোনা ভাইরাস। করোনা ভাইরাসের কারণে এর মধ্যেই অহেতুক ভীতি ও বর্ণবিদ্বেষের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করেছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণার পূর্বাভাস যদি সঠিক হয়, তাহলে সামাজিক ও মনস্তত্ত্বের ক্ষেত্রে বড়ো ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে।
মানব মনস্তত্ত্বের অন্যান্য বিষয়ের মতো রোগব্যাধির ক্ষেত্রে আচরণের বিষয়টি বোঝার জন্য ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা আবিষ্কারের আগে সংক্রামক ব্যাধি ছিল মানুষের টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে বড়ো হুমকি। তখন মানুষের শরীরে যে প্রতিরোধব্যবস্থা কাজ করত, তার ফলে মানুষ খানিকটা ক্লান্ত, ঘুমকাতুরে বোধ করত। তখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের নিয়মিত কার্যকলাপÑযেমন শিকার করা, জড়ো হওয়া বা শিশুদের লালন-পালন করার মতো কাজগুলো ঠিকভাবে করতে পারত না।
হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে মানুষের এই ভীতি তৈরি হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে আচরণগত প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলা। যা কিছু আমাদের শরীরের জন্য খারাপ হতে পারে, সেটা আমরা এড়িয়ে যেতে চাই, তার বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিরোধমূলক আচরণ তৈরি করি।
ভ্যাংকুভারের ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার অধ্যাপক মার্ক স্কলার বলছেন, এটা অনেকটা মেডিক্যাল ইনস্যুরেন্সের মতো। এটা থাকা ভালো, কিন্তু যখন আপনি সেটা ব্যবহার করা শুরু করবেন, তখন দ্রুত ফুরিয়ে যাবে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব জিনিস আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়েছে, সেগুলো আমাদের মনের ভেতরে থেকে যায়। ফলে এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি তৈরি হলে, যা আমাদের ভবিষ্যতে বিপদে ফেলতে পারে, সেগুলো আমরা এড়িয়ে যাই।
মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব, অনেকের সঙ্গে একত্রে মিলেমিশে থাকতে অভ্যস্ত, তাই রোগের বিস্তার ঠেকাতে তখন মানুষের সঙ্গে চলাফেরা, মেলামেশার ধরনের ওপরেও পরিবর্তন আসে। ফলে রোগের সংক্রমণ এড়াতে মানুষ সামাজিক দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করে।
আর্থাউস ইউনিভার্সিটি অব ডেনমার্কের অধ্যাপক লেনে অ্যারোয়ি বলছেন, অনেক সময় এ ধরনের আচরণ ভুল হতে পারে, হয়তো ভুল তথ্যের ভিত্তিতে হতে পারে, হয়তো আমাদের নীতিগত অবস্থান বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করেও হতে পারে। লেখক অ্যারোয়ি যেমন দেখতে পেয়েছেন, সংক্রামক রোগের ভীতির কারণে অভিবাসন নিয়ে অনেক মানুষের মনোভাব বদলে গেছে। তিনি মনে করেন, মানুষের ভেতরে যে আচরণগত প্রতিরোধব্যবস্থা আছে, যার কারণে মানুষ মনে করে যে ‘দুঃখিত হওয়ার চেয়ে নিরাপদ হওয়া জরুরি’, সে কারণেই তারা এরকম আচরণ করতে পারে। অ্যারোয়ি বলছেন, কিছু মানুষের মধ্যে বিশেষভাবে স্পর্শকাতর আচরণগত প্রতিরোধব্যবস্থা কাজ করে, ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি আছে, এসব কিছুর ক্ষেত্রে তারা জোরালো আচরণের প্রকাশ ঘটায়। করোনা ভাইরাস আমাদের ব্যক্তিগত আচরণের ওপর কী প্রভাব ফেলছে, সেটাই বরং বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কি অন্যান্যের প্রতি বেশি সচেতন হয়ে উঠছি? অন্যান্যের আচরণ বিচার-বিশ্লেষণ করছি? নিয়মকানুনের গুরুত্ব কি বুঝতে পারছি? আমাদের চিন্তাভাবনা কি স্বাভাবিক রয়েছে? নাকি হাজার বছর আগে সংক্রামক রোগ ছড়ানোর সময় আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে আচরণ করেছিলেন, সেটাই আমরা অবচেতনে প্রকাশ করে চলেছি?
ঘরে দীর্ঘদিন বন্দী হয়ে থাকলে সাধারণ অভ্যাসগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। অপরিমিত জীবনযাপন শরীরের জন্য, বিশেষ করে শিরার জন্য খুবই ক্ষতিকর। এই অলস সময়েও কীভাবে সুস্থ থাকবেন জেনেনিন।
সব সময়ই হাঁটাচলা করবেন। প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটবেন। যখন মোবাইলে কথা বলবেন, তখনও।
পায়ের গোড়ালির সাধারণ ব্যায়ামগুলো করবেন। এগুলো আপনার কাফ্ মাসলের পাম্প চালু রাখবে। যোগব্যায়াম করতে পারেন। দাঁড়িয়ে এবং শুয়ে, দুই ভাবেই ব্যায়াম করবেন।
বাড়িতে সিঁড়ি থাকলে ওঠা-নামা করতে পারেন।
কোথাও বসে থাকার সময়ে একটা টুলের উপরে পা তুলে বসবেন। শোওয়ার সময়ে বালিশের উপরে পা তুলেরাখবেন।
মিউজিকের তালে তালে ব্যায়াম করলে মানসিক চাপ কমতে পারে অনেকের ক্ষেত্রে। উপরের টিপসগুলো পায়ের শিরায় রক্ত জমাট বাধা থেকে রক্ষা করে এবং শিরার শক্তি বাড়ায়।
প্রচুর পানি পান করতে হবে। সাধারণত পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া এবং আপনার হার্টের অবস্থার উপর ভিত্তি করে দুই থেকে আড়াই লিটার পানি পান করবেন প্রতিদিন। প্রচুর পানি পান করলে রক্তের ঘনত্ব ঠিক থাকবে। চা, কফি বা ক্যাফেইন সমৃদ্ধ পানীয় কম খাবেন, কারণ এগুলো শরীরে পানিশূণ্যতা সৃষ্টি করে এবং রক্তের ঘনত্ব বাড়ায়।
প্রচুর পরিমাণে সবুজ শাকসবজি এবং মৌসুমী ফল খাবেন। ভাজা-পোড়া, চর্বিযুক্ত খাবার, মিষ্টিজাতীয় খাবার কম খাবেন। শরীরের ওজন স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে হবে।
আঁটসাঁট পোশাক পরবেন না।
ধূমপান ও তামাক সেবন পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে।
ডায়াবেটিস থাকলে বাসাতেই গ্লুকোমিটার দিয়ে নিয়মিত রক্তের সুগার মাপার চেষ্টা করুন।
প্রয়োজনে আপনার রক্তনালী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে ফোন বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যোগাযোগ করবেন।
সব সময়ে হাসিখুশী থাকার চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখবেন, এই দুঃসময়ের অবসান হবেই।
বিশেষ ভাবে মনে রাখতে হবে
যাদের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, হাঁপানি ইত্যাদি আছে অথবা যাদের বয়স ৬০ এর ঘরে, তাদের অতিরিক্ত সতর্ক থাকা প্রয়োজন। আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে অবশ্যই যোগাযোগ রাখবেন।
ঘরে থাকুন, সাবধানে থাকুন। করোনা রোগজনিত ভয়কে না বলুন, প্রতিরোধকে হ্যাঁ বলুন। তাহলেই একদিন এর থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।