স্বপদে ফিরতে শুরু করেছে অনিয়ম-দুর্নীতে জড়িত তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা। করোনা মহামারীকালে ত্রাণসামগ্রী বিতরণে দুর্নীতির অভিযোগে বিপুলসংখ্যক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যকে (মেম্বার) বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু তারা আদালতের আশ্রয় নিয়ে সরকারের বরখাস্ত আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ এনে নিজ নিজ পদে ফিরে আসছে। ইতিমধ্যে অন্তত ৩০ জন চেয়ারম্যান উচ্চ আদালতের রিট করে নিজ পদ ফিরে পেয়েছে। বাকিরাও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে। অভিযোগ উঠেছে সরকার কর্তৃক বরখাস্তকৃত জনপ্রতিনিধিরা আদালতের মাধ্যমে নিজ পদে ফিরে এসে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদের নানাভাবে হয়রানি করছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, করোনা মহামারীকালে ভিজিএফের চাল আত্মসাৎ, কর্মস্থলে অনুপস্থিত ও প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নগদ অর্থ সহায়তার সুবিধাভোগীদের তালিকা প্রণয়নে ব্যর্থ হওয়ায়, ত্রাণকাজে সহায়তা না করা, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল আত্মসাৎ, এলাকায় অবস্থান না করা, ভিজিডির চাল আত্মসাৎ, ত্রাণ আত্মসাৎ ও গুজব ছড়ানো, ভুয়া মাস্টাররোলের মাধ্যমে ত্রাণের চাল আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অভিযোগে তৃণমূল পর্যায়ের বিপুলসংখ্যক জনপ্রতিনিধিকে সরকার বরখাস্ত করেছিল। কিন্তু সঙ্কটকালে সাধারণ মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে যারা নানা অনিয়ম ও দুর্নীতে জড়িত ছিল তারা আবার স্বপদে ফিরে আসা অনেকেই ভালো চোখে দেখছে না। কারণ বরখাস্ত হওয়া জনপ্রতিনিধিরা উচ্চ আদালতে রিট করে আবার স্বপদে ফিরে আসার সুযোগে দুর্নীতিবাজরা আরো বেপরোয়া ও উৎসাহিত হবে। অপকর্মের ক্ষেত্রে তাদের সাহসও আরো বাড়বে। আদালতে যখন শুনানির জন্য মামলাটি উঠে তখন সরকারপক্ষের আইনজীবী এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে যথাযথ পদক্ষেপ নিলে বারখাস্তকৃত এতো লোক ফেরত আসা সম্ভব হতো না। কিন্তু যথাযথ পদক্ষেপের অভাবেই সরকার অনেক মামলায় হেরে যায়। ভূমি ও ব্যাংক ঋণ মামলায় সরকারপক্ষের আইনজীবীরা শক্ত ভূমিকা না নেয়ার কারণে অনেক প্রকৃত মামলা যেগুলোতে সরকার জেতার কথা সেগুলোতেও হেরে যায়।
সূত্র জানায়, আদালতে রিট করার পর সরকারপক্ষে যেসব আইনজীবী থাকেন তারা বরখাস্তের পক্ষে জোরালোভাবে আদালতে নথিপত্র ও তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন না। অনেক ক্ষেত্রে সরকারপক্ষের আইনজীবী আদালতে উপস্থিতও হন না। বিপরীতে আসামিপক্ষ বা বরখাস্ত জনপ্রতিনিধিদের পক্ষের আইনজীবীরা জোরালোভাবে বরখাস্তের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান আদালতে তুলে ধরেন। তখন আদালত সরকারের বরখাস্ত আদেশ স্থগিত করে দেয়। অভিযোগ রয়েছে, সরকারপক্ষের আইনজীবীরা আসামিপক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে যোগসাজশ করেই আদালতে কোনো রকম তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা থেকে বিরত থাকেন। ফলে অভিযুক্ত জনপ্রতিনিধিরা আবার দায়িত্বে ফিরে আসার সুযোগ পাচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে চলতি বছরের ২৬ মার্চ থেকে সরকার সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। দফায় দফায় ৩০ মে পর্যন্ত ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। সাধারণ ছুটি ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যেই সরকার সারা দেশে কর্মহীন, দরিদ্র. দিনমজুর, রিকশা ও ভ্যান শ্রমিকসহ এমন শ্রেণির লোকজনের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ শুরু করে। ওই ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চালাতে গিয়ে শুরু থেকেই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, সদস্য, পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে ত্রাণের চাল, ডাল, তেল এবং নগদ টাকা বিতরণে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অনড় অবস্থানের কারণে মাঠ প্রশাসন ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, সদস্য, পৌরসভার মেয়র, কাউন্সিলর, এমনকি জেলা পরিষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া শুরু করে। অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পর সারা দেশ থেকে জেলা প্রশাসকরা সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগে পত্র দেন। তার আলোকে অভিযুক্ত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করা হয়। মূলত চলতি বছরের এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দুর্নীতির অভিযোগে জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করা শুরু হয়ে ত্রাণ আত্মসাৎ এবং ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে মে মাস পর্যন্ত অব্যাহতভাবে জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করা হয়। জনস্বার্থের পরিপন্থী বিবেচনায় স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯-এর ৩৪(১) ধারা অনুযায়ী তাদের স্বীয় পদ থেকে মোট ১০৮ জন জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। আর বরখাস্ত করেও যখন জনপ্রতিনিধিদের দুর্নীতি ও অনিয়ম ঠেকানো যাচ্ছিল না, তখন সরকারপ্রধানের নির্দেশে সারা দেশের মাঠ প্রশাসনকে ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব দেয়া হয়। আর ৬৪ জেলায় এ কাজ মনিটরিং করেন ৬৪ জন সিনিয়র সচিব ও সচিব। তারপর ত্রাণ বিতরণে অনেকটা শৃঙ্খলা ফিরে আসে। বর্তমানে বরখাস্ত চেয়ারম্যানদের মধ্যে এ পর্যন্ত অন্তত ৩০ জন নিজ পদ ফিরে পেতে উচ্চ আদালতে রিট করে। আদালত তাদের রিটের শুনানি করে প্রত্যেকের বরখাস্ত আদেশ স্থগিত করেছে। ফলে বরখাস্ত হওয়া ওই চেয়ারম্যানরা স্বপদে ফিরে আসছে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম জানান, আদালত যখন আদেশ দেয় তখন তা মানতে হয়। তবে এর বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। সরকারপক্ষ প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত নিয়েই আদালতে আপিল করবে। পাশাপাশি সরকারপক্ষের আইনজীবীদের আরো সিরিয়াস হতে বলা হবে এবং কিছু আইনজীবী পরিবর্তনও করা হবে।