পর্যাপ্ত নিরাপত্তা কর্মীর অভাব, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে অক্ষমতা, পুলিশ টহলের ব্যবস্থা না থাকা এবং সিসিটিভি ও স্পাই ক্যামেরার অভাবে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পল্লী অঞ্চলের শাখাগুলো মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। ব্যাংকগুলো পল্লী অঞ্চলের ব্যাংক শাখার নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া নির্দেশনাগুলোও মানছে না। মূলত খরচ বাঁচাতেই ব্যাংকগুলো যথাযথ নিরাপত্তার উদ্যোগ নিচ্ছে না। কারণ এখন ব্যাংকগুলোতে ব্যয় সংকোচন নীতি চলছে। এমন অবস্থায় গ্রামীণ এলাকার এটিএম বুথ ও এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমে ঝুঁকির মাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আউটলেট থেকে টাকা খোয়া যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। তাছাড়া গ্রামের এটিএম বুথগুলো এখন হ্যাকারদেরও টার্গেটে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১৫ সালে ব্যাংকের শাখা, এটিএম বুথ ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারি করা সার্কুলার অনুযায়ী প্রতিটি শাখার প্রবেশপথে, ভেতরে, বাইরে, আইটি রুমে সিসিটিভি, আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) ক্যামেরা ও স্পাই (গোপন) ক্যামেরা স্থাপন করার কথা বলা হয়েছে। আর সেগুলো যথাযথ কর্মকর্তা দিয়ে পরিচালনা করতে হবে। কখনই ক্যামেরা বন্ধ করা যাবে না। ভিডিও ফুটেজ এক বছর সংরক্ষণ করতে হবে। ব্যাংকের শহুরে শাখায় এসব ব্যবস্থা থাকলেও বেশিরভাগ গ্রামীণ শাখায় তা নেই। কোথাও সিসিটিভি থাকলেও আইপি বা স্পাই ক্যামেরা নেই। সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্যও নেই যথাযথ কর্মকর্তা। অনেক ক্ষেত্রেই বাইরের কর্মকর্তা দিয়ে সেগুলো পরিচালিত হচ্ছে। তাছাড়া ব্যাংকের সব শাখায় পর্যায়ক্রমে এন্টি থেফ্ট এলার্ম বসানোর নির্দেশনা থাকলেও গ্রামীণ শাখাগুলোতে তা নেই। প্রতিটি শাখায় একাধিক নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু গ্রামের বেশিরভাগ ব্যাংকের শাখায় নিরাপত্তা কর্মী আছে মাত্র একজন। যাকে অনেক ক্ষেত্রে জনবল সংকটে অফিস সহকারী বা পিয়নের কাজও করতে হয়। আবার কোথাও কোথাও এমন নিরাপত্তা কর্মী রয়েছে যারা তাদের আগ্নেয়াস্ত্র সচল কিনা জানেন না। কারণ কোনো দিন ওই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করতে হয়নি এবং কখনো মেরামতও করা হয়নি।
সূত্র জানায়, সরকারি ব্যাংকগুলোর ভল্টের নিরাপত্তার ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। পরে বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রেও তা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী ভল্টের ছাদ ও মেঝেসহ চারপাশের দেয়াল পুরপ্রকৌশল বিভাগ কর্তৃক সত্যায়িত হতে হবে। ভল্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সার্বক্ষণিক থাকতে হবে। ভল্টের প্রবেশপথে সিসিটিভি, ভেতরে স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকতে হবে। ভল্টের ও এটিএম বুথে জমা অর্থের ওপর থাকবে বীমা ঝুঁকি। সেজন্য আলাদা তহবিল গঠন করতে হবে। শহুরে শাখায় এ বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হলেও গ্রামীণ শাখা একেবারেই অবহেলিত। ভল্ট বা এটিএম বুথে জমা টাকার ওপর কোনো বীমা নেই। অথচ ব্যাংকে সম্ভাব্য চুরি-ডাকাতি বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিটি শাখায় স্বয়ংক্রিয় এলার্ম সিস্টেমস স্থাপন করার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু অনেক শাখায় তা নেই। ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়, থানা, র্যাবসহ অন্যান্য ১০টি গুরুত্বপূর্ণ নম্বরে হটলাইন থাকার নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। তাছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংক শাখার চারপাশের বাসিন্দাদের তথ্য রাখা ও তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে সামাজিক সম্পর্ক রাখতে হবে। কিন্তু শহর বা গ্রামীণ শাখার ব্যবস্থাপকরা এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
সূত্র আরো জানায়, ব্যাংকের শাখাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন তৈরি করছে। ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ থেকে যেসব পরিদর্শক দল শাখায় যাচ্ছে তারা শাখার সার্বিক নিরাপত্তার পাশাপাশি ভল্টের নিরাপত্তার মান নিয়েও প্রতিবেদন তৈরি করে। তাছাড়া ব্যাংকগুলোও নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে ঘাটতি থাকলে ব্যবস্থা নেয়া উদ্যোগ গস্খহণ করা হচ্ছে।
এদিকে সরকারি ও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে রাত্রিকালীন ব্যাংক কর্মকর্তা সুনির্দিষ্ট শাখা পরিদর্শন করার নিয়ম রয়েছে। তা অনেকেই করে থাকেন। প্রতিটি শাখাকে নিকটস্থ থানার সঙ্গে কথা বলে নিরাপত্তা ও পুলিশি টহলের ব্যবস্থা রাখার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু নানা ব্যস্ততার কারণে পুলিশ এ ধরনের টহল বেশিরভাগ সময়ই দিতে পারে না বলে অভিযোগ রয়েছে। নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নে একটি ব্যাংকের শাখা রয়েছে। সেটি সদর থানা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। ফলে সেখানে সব সময় টহল পুলিশ পাওয়া যায় না।
অন্যদিকে বর্তমানে সারা দেশে ৫৯টি ব্যাংকের শাখা রয়েছে ১০ হাজার ৫৮৮টি। তার মধ্যে শহরের শাখা ৫ হাজার ৩৬৯টি এবং পল্লীর শাখা ৫ হাজার ২৭টি। তাছাড়া ইসলামিক ব্যাংকিং ইউন্ডো এবং এসএমই সার্ভিস সেন্টার রয়েছে ১০ হাজার ৬৮৫টি। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট ৮ হাজার ৭৬৪টি এবং আউটলেট ১২ হাজার ৪৪৯টি। এটিএম বুথ ১১ হাজার ও পস মেশিন ৫৪ হাজার।
পল্লী অঞ্চলের ব্যাংক শাখার নিরাপত্তা প্রসঙ্গে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরী জানন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের চেয়ে বেড়েছে। যে কারণে ব্যাংকের শাখায় চুরি-ডাকাতি কমে এসেছে। সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন থেকেও ব্যাংকের নিরাপত্তায় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।