কোনো কারণ ছাড়াই দেশের ভোজ্যতেলের বাজার অস্থির হয়ে উঠছে। ব্যবসায়ীদের মতে, দেশের ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী মিলগুলো থেকে সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারে প্রতিদিনই ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে। বর্তমানে এক দশকের মধ্যে ভোজ্যতেলের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। আমদানি ও সরবরাহ নিশ্চিত না হলে দাম আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিগত ২০০৮ সালে এদেশে ভোজ্যতেলের বাজারে চরম অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল। তার প্রধান কারণ ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি, বিশেষ করে ওই বছরের মার্চে মালয়েশিয়ার ফিউচার মাকের্টে প্রতি টন পাম অয়েলের দাম প্রায় ৪ হাজার রিঙ্গিতে পৌঁছার ঘটনা ঘটেছিল। এবার সে রকম কোনো কারণ না থাকলেও দেশে হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠেছে পাম অয়েলের বাজার। বাজার সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, করোনা সংক্রমণ শুরুর আগে প্রতি মণ পাম অয়েলের দাম যেখানে ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার টাকার মধ্যে ছিল, সেখানে গত সপ্তাহে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে প্রতি মণ পাম অয়েলের দাম ৩ হাজার ১২০ টাকায় দাঁড়ায়। তারপর থেকেই পাম অয়েলের পাইকারি দামে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আরদামের এমন উত্থান-পতনে পাইকারি পর্যায়ে ভোজ্যতেলের ব্যবসায় ঝুঁকি বাড়ছে। তবে দেশে ভোজ্যতেলের বাজার হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার পেছনে ব্যবসায়ীরা আমদানি হ্রাস পাওয়াকেও দায়ি করছে। তাদের মতে, দেশে পাম অয়েল আমদানিতে প্রধান দুটি উৎস দেশ মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে উত্তোলন মৌসুম শুরু হলেও কভিড-১৯-এর কারণে শ্রমিক সংকট থাকায় মজুদ ও সরবরাহ সংকটে রয়েছে দেশ দুটির উৎপাদকরা। আর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণকালে দেশ দুটি থেকে আমদানি অনেক কমে যায়।
সূত্র জানায়, দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে গত রোববার প্রতি মণ পাম অয়েলের দাম ৩ হাজার ১২০ টাকায় দাঁড়ায়। তারপর ভোজ্যতেলের বাজার উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে গতকাল অপরিশোধিত পাম অয়েলের লেনদেন হয়েছে প্রতি টন ২ হাজার ৭৮৬ রিঙ্গিতে (৫৬ হাজার ৫৫৫ টাকা)। ইনডেক্স মুন্ডির তথ্যানুযায়ী চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রতি টন পাম অয়েলের মূল্য ছিল ৩ হাজার রিঙ্গিতের ওপরে। আর মার্চে ২ হাজার ৭৩৩, এপ্রিলে ২ হাজার ৬৫১, মে মাসে ২ হাজার ৪৯৩, জুনে ২ হাজার ৭৮৫, জুলাইয়ে ২ হাজার ৯৫৯ রিঙ্গিতে লেনদেন হয়েছে প্রতি টন পাম অয়েল।
এদিকে পাম অয়েলের আমদানির ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে গত জুলাই-আগস্টে দেশে পাম অয়েল আমদানিও কমেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস অর্থাৎ জুলাই-আগস্টে দেশে ২ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৪ টন পাম অয়েল আমদানি হয়েছিল। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে আমদানি হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ৭৭৫ টন। মূলত সর্বশেষ দুই মাসের আমদানিতে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ঘাটতি থাকায় দেশের বিভিন্ন মিল থেকে পাম অয়েলের সরবরাহ তুলনামূলক কম। এ কারণে দেশের অনেক পরিশোধন মিল পাম অয়েলের সরবরাহ দিতে না পারায় বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে। বিগত এক মাস ধরে দেশের অধিকাংশ পরিশোধন মিল থেকে ভোজ্যতেলের সরবরাহ জট তৈরি হয়। চট্টগ্রামের এস আলম রিফাইনারি ছাড়া সারা দেশের অন্যান্য মিল থেকে ভোজ্যতেল সংগ্রহ করতে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কয়েক দিন পর্যন্ত সময় লাগতো। কিন্তু এখন চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকায় মিলগেটে ভোজ্যতেল সংগ্রহে আসা যানবাহনগুলোকে সময়ক্ষেপণ করতে হচ্ছে। আর মিলগেট থেকে সরবরাহ সংকট পাইকারি বাজারকে আরো বেশি উসকে দিয়েছে। হঠাৎ উত্থান-পতনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে খাতুনগঞ্জের অনেক ব্যবসায়ী বড় ধরনের লোকসানের কবলে পড়ে মূলধন হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে।
অন্যদিকে পাইকারি বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, করোনার কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণার আগে দেশে পাম অয়েলের বাজারদর ছিল মণপ্রতি ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকা। দীর্ঘ ছুটিতে পাইকারি বাজারে ডিও ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি কমে যাওয়ায় দীর্ঘদিন পাম অয়েলের দাম স্থিতিশীল ছিল। তবে জুনের পর থেকে বাজারে ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি বৃদ্ধির পর ডিও লেনদেনও বেড়ে যায়। পাশাপাশি মিলগেট থেকে পাম অয়েল উত্তোলনে সময়ক্ষেপণ হওয়ায় ভোজ্যতেলের বাজার চাঙ্গা হতে শুরু করে। কয়েক মাস ধরে দাম বাড়তে থাকায় ডিও ব্যবসায়ীরাও ভোজ্যতেলের ডিও ও স্লিপ ক্রয়ের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। এভাবে গত কয়েক মাসে ডিও ও স্লিপ ক্রয়ের পেছনে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে সাধারণ ব্যবসায়ীরা। গত বৃহস্পতিবার ডিও পর্যায়ে পাম অয়েলে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৮০০ টাকা। তাছাড়া সুপার পাম অয়েল ৩ হাজার ১০০ টাকা এবং সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৪০০ টাকায়। যদিও এক সপ্তাহ আগেও সয়াবিন লেনদেন হয়েছিল ৩ হাজার ৫০০ টাকায় এবং সুপার পাম অয়েল লেনদেন হয়েছিল ৩ হাজার ২৮০ টাকায়।
ভোজ্যতেলের বাজারে এমন উত্থান-পতন নিয়ে সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা জানান, বৈশ্বিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম অনেক বেড়েছে। এ কারণে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন চাহিদা ও সরবরাহে জটিলতা থাকলেও বর্তমানে দুটোই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এ কারণে বাজারে হঠাৎ চাহিদা বাড়ায় বাজারেও এর প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক। আমদানি স্বাভাবিক রাখার মাধ্যমে আমদানিকারকরা সংকট এড়ানোর চেষ্টা করছে।