২০০১ সালের ৪ঠা আগষ্ট শুক্রবার বিকাল পাঁচটায় ঢাকার গ্রীন রোডের আল-আমিন নামক গলি রাস্তার চার তলা বাড়ীর চত্বরে কমিউনিটি পার্টির ধানমন্ডি থানা শাখার উদ্যোগে কমরেড মনি সিংহের জন্মশত বার্ষিকী পালিত হয়। তিনি ১৯০১ সালের ২৮ শে জুলাই তারিখে জন্ম গ্রহণ করেন। মূল দিবসটিতে ক্রেন্দ্রিয় ভাবে জাতীয় অনুষ্ঠান পালিত হয়ে ছিল বলে মনি সিংহের জীবিতকালীন বাসস্থান ফ্রী স্কুল স্ট্রীটে স্থানীয় ভাবে অনুষ্ঠান পালিত হয়।
মূল জাতীয় অনুষ্ঠান সংগঠিত ও সম্পন্ন হয় কমিউনিষ্ট পার্ঠির ক্রেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যেগে। ঐ অনুষ্ঠানে আওয়ামীলীগ সরকারের মন্ত্রী আব্দুল সামাদ আজাদ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ভিন্ন একটি রাজনৈতিক দল। যোতদার সামাজিক ঘোষ্ঠির নেতা.......শ্রেনীর দল আওয়ামীলীগ এর দুই নম্বর নেতা কমিউনিষ্ট পার্টিে সাথে তার অতীত সম্পর্কের বিষয় উল্লেখ করে অনেক স্মৃতি চারন করেন। আব্দুস সামাদ আজাদ সিলেট অঞ্চলের যোতদারের পরিবারের সন্তান। বর্তমানে ঢাকায় নিজ বাসভবনে বসবাসরত। উল্লেখ্য মনি সিংহও যোতদার পরিবারের সন্তান। তবে ১৯৪০-৫০ সালের তে-ভাগ ও টংক আন্দোলনের পর তদানিপ্তন মুসলিমলীগ সরকার তাদের সমস্ত জমি বাজেয়াপ্ত করে তিনি ভূমিহীন হয়ে যান। কমিউনিস্ট বিশেষ করে তে-ভাগ আন্দোলনের কারনে অনেকের মত তারও উপর প্রতিক্রিয়াশীল নামক গোষ্ঠীর আঘাত নেমে এসেছিল। সামাদ আজাদ তার পৈতৃক আবাসভূমি ও জন্মস্থান থানায় নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচীত জাতীয় সংসদ সদস্য। জাতীয় অনুষ্ঠানে আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বাম বলে কথিত পার্টিগুলোর নেতারাও মনি সিংহের সাথে তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্রে কত অনেক ঘটনা ও কাহিনীর স্মৃতিচরন করেন।
জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানে বক্তদের মোট সংখ্যার বিশ ভাগের এক ভাগ ছিলেন শ্রমিক বা শ্রমিকনেতা। আর বাকিরা ছিলেন অনুপস্থিত ভূমি-মালিক ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবি কমিউনিস্ট পার্টির ধানমন্ডি শাখার অনুষ্ঠানে ও ভূমি মালিক, সম্পত্তি মালিক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, শ্রমিক নেতা ও বুদ্ধিজীবিগন উপস্থিত ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির সাধারন সম্পাদক মোযাহিদুল ইসলাম সেলিম, মোর্শেদ আলি এবং কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। পূর্বে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত বর্তমানে আওয়ামী লীগের সদস্য ও ক্রেন্দ্রীয় নেতা কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী থেকে শুরু করে শিক্ষক নেতা আব্দুল জলিল ভূইয়া পর্যন্ত সকলেই বক্তব্য রাখেন। অনেকেই মনি সিংহকে বড় ভাই বলে সম্বোধন করে তার সাখে তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের নিবিরভাবে উল্লেখ করেন; পূর্বতন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টি জোরালেভাবে উপস্থাপন করেন। অথচ ষাট এর দশকের প্রথম দিকে উচ্চরন করতে ভয় পেতেন। মনি সিংহ যদিও ছিলেন যোতদার পরিবারের সন্তান, কিন্তু প্রথমে ভারতের স্বাধীনতা কর্মী গোপন দল ও পরে কমিউনিষ্ট পার্টির রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে বিশেষ করে তে-ভাগা আন্দোলন ও টংক- প্রথা বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে এক নতুনতর রাজনৈতিক চেতনায় উত্তীর্ণ হন। (উল্লেখ্য, “তে-ভাগা” ঔপনিবেশিক বাংলার শেষ বৃহৎ কৃষক আন্দোলন। তবে এটা সংশয়তীত নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-১৮৬০) বাদ দিলে এত বড় কৃষক আন্দোলন বাংলায় আর হয়নি। গোটা কৃষক সমাজ অবশ্য এতে যোগ দেয়নি। এটা প্রধানত ভাগচাষীদের আন্দোলন জমির মালিক, যোতদারদের বিরুদ্ধে। সাবেকী প্রথা ছিল ফসলের অর্ধেক যোতদার পাবে। এমন ভাগচাষীদের দাবী, এক তৃতীয়াংশের বেশি তারা দেবেনা। জমির মালিক আসলে কৃষক এমন বৈপ্লাবিক ঘোষনাও কোথাও কোথাও হয়েছিল। বিনয় চৌধুরী উনবিংশ শতাব্দির ‘জমিদার’ শ্রেনী অপেক্ষা ও বিংশ শতাব্দীতে ‘যোতদার’ শ্রেনী গ্রাম বাংলায় আরো ভয়াবহ চেহারায় আত্মপ্রকাশ করেছিল। অধ্যাপক গোপাল হালদারের ভাষায় বলতে হয় জমিদারের তাও একটা কালচার ছিল যোতদারের সেটুকু ও ছিলনা বস্তুত পক্ষে এই যোতদার শ্রেনী ও তাদের প্রধান মিত্র গ্রামীন কুসীদ মীঠা ‘মহাজন’ শ্রেনীর (কখনও কখনও এঁরা একই অর্থে দুই রূপেই বিরাজ করতেন) পেষনে কি ভাবে দরিদ্র কৃষক সমাজ পিষ্ট বিনয় ভূষন চৌধুরী পর্যন্ত নানা জনে নানাভাবে বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্বর কালে বিশেষত ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দের মহা মন্বস্তরের পরে বাংলার কৃষি ক্ষেতে মহা বিপর্যয় নেমে এসেছিল। এর সুযোগ পূর্নমাত্রায় গ্রহণ করে গ্রামীন সামন্তশাসনের প্রতিভূ ওই দুই পরজীবী শ্রেনী। কৃষকের জমি হস্তচ্যুত হবার প্রবনতা এই সময়কালেই বেশী বৃদ্ধি পায়। রায়ত চাষী ক্রমশ বর্গাদারে এবং ভাগচাষী ক্রমশ ক্ষেতমজুরে পরিনত হয়। ঔপনিবেশিক বাংলার শেষ কৃষক সংগ্রাম তে-ভাগা আন্দোলনের সৃষ্টি প্রধানত এই পেক্ষাপটে ১৯৪৬-৪৭ সালে তে-ভাগা কৃষক আন্দোলন তুঙ্গেঁ উঠে অধিভুক্ত বাংলার ২৬টি জেলার মধ্যে ২৪টিতেই ষাট লক্ষাধিক বর্গাচাষী/ভোগচাষী ক্ষেতমজুরদের উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ অধিকারের এই সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়েছিল।
টংক প্রায় ধানের ফসলে জমিদারকে খাজনা দিতে হত। এই ফসলের পরিমান লিখিত হতনা। জমিদারদের দ্বারা মৌখিকভাবেই স্থায়ীকৃত হত। ধানী ফসলের খাজনা না দিলে হাতি দিয়ে কৃষকের বাড়ী-ঘর সড়িয়ে দেয়া হত। এর প্রথা বৃহত্তর পুরাতন ময়মনসিংহ জেলার উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বিরাহিত ছিল। ১৯৬৯-৪০ সালে ময়মনসিংহ জেলা ললিতাবাড়ী,দূর্গাপুর, লামিকাদা এলাকায় টক্ক আন্দোলন সফল হয়। সেখানে জমিতে কৃষকদের স্বত্ব ও টাকায় খাজনা দেবার অধিকার ইত্যাদি দাবি আংশিকতার স্বীকৃত হয়। তারই ফল শ্রুতিতে তিনি ঘোষনা করেন যে, জমি কেরে নিয়ে, চাষীদের হাতে দিতে হবে। কিন্তু তার সে আশার পূরন হয়নি।
ষাট দশকের মধ্যভাগ থেকে কমিউনিস্ট পার্টিতে আদর্শগত দ্বন্দের কারনে পার্টি প্রথমত দুই ভাগে বিভক্ত হয়। একটি পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলার বিচ্ছিনতা ও স্বাধীনতার দাবী প্রধান দাবী হিসেবে ঘোষনাকারী জাতীয়তাবাদী ধারা। অন্যটি কৃষকের মুক্তি তথা গণতান্ত্রিক বিপ্লব তথা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারা মনি সিংহ প্রমুখেরা জাতীয়তাবাদী ধারার সাথে যুক্ত হয়ে পড়ার ফলে পরবর্তীতে মনি সিংহ নিজে যোতদারী ব্যবহার বিরুদ্ধে কথা বললেও, তার পার্টিকে নিয়ে যোতদারের বিরুদ্ধে অতিক্রমন সংহত করে গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সফল করে তুলতে পারেননি। সেটা তার পক্ষে সম্ভব ও হয়নি। মনি সিংহ মৃত্যু বরণ করেন ১৯৯১ সালে। ১৯৯৩ সালে পার্টি ভেঙ্গে যায়। কেন্দ্রীয় কমিটির পনের জন বাদে সকল সদস্যই পদত্যাগ করে অথবা না করে অন্য পার্টি গড়ার দিকে নিয়োজিত হন। এ সকল লোকেরা শ্রমিক শ্রেনীর আদর্শ ত্যাগ করেন। মার্কসবাদ লেনিনবাদের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করেন পার্টির নাম কমিউনিস্ট পার্টির নামকে পর্যন্ত অস্বীকার করে। কমিউনিস্ট পার্টি বিলুপ্ত করার ধারার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন।
কমিউনিস্ট পার্টিতে যারা থেকে যান এবং কমিউনিস্ট পার্টিকে পূর্নগঠিত করে তোলেন তারা ও বিগত সাত বছরে মনি সিংহ কর্তৃক উচ্চারিত “জমিচোর যোতদারদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নিয়ে” চাষিকে জমি দেয়ার কর্মসূচিতে ফিরে যাননি। কারন সাত বছর পর দুই হাজার সালেও কমিউনিষ্ট পার্টির ক্রেন্দ্রিয় কমিটির দুইজন বাদে সকল সদস্যই গ্রাম্য যোতের মালিক অনুপস্থিত ভূস্বামী, শহরে সম্পত্তি মালিক অথবা পেটিবুর্জোয়া শ্রেনী থেকে আগত বুদ্ধিজীবী। মনি সিংহের জন্ম শত বার্ষিকীতে ধানমন্ডি থানার অনুষ্ঠানে সম্পত্তি মালিকগন তাদের নানান বক্তব্য খুনাক্ষরে ও চাষীকে জমি দেওয়া অথবা শহরে জমির সিলিং নির্ধারন অথবা জমি রাষ্ট্রীয়ত্বকরণ করা সর্ম্পকে কোন কথাই উচ্চারন করেন নি।
নাটকের এখানেই শেষ ছিলনা ট্রাজেডি বেদনাদায়ক ও মর্মবিদারী হয় তখন, যখন বক্তৃতা দেয়ার জন্য অনেক শ্রমিক নেতার নাম উচ্চারন করা হয়। নাম উচ্চারন করার সাথে সাথেই শ্রোতা ও দর্শকের চেয়ারে বসে থাকা উক্ত ট্যানারী শ্রমিক নেতা চেয়ার থেকে ঝট করে উঠে মঞ্চের দিকে অগ্রসর হয়ে মঞ্চে পা রাখতেই সভা-পরিচালক তাকে আরও অগ্রসর হতে বারন করেন। আচমকা বাধা পেয়ে স্তব্দ শ্রমিক নেতা থমকে দাড়ালেন। তারপর নীরবে ফিরে এসে মঞ্চের অদূরে রাখা চেয়ারে এসে বসলেন।
উল্লেখ্য, এই শ্রমিক নেতাই প্রায় পঞ্চাশ জন শ্রমিক নিয়ে ব্যানারসহ শ্লোগান দিতে দিতে আলোচনা সভাস্থলে এসে হাজীর হন। তখনই আলোচনা সভাস্থলে লোকজনের সমাগমে ভরে উঠে। গম গম করে উঠে উপরোক্ত শ্রমিক নেতা শ্রমিকদেরকে না নিয়ে এলে আলোচনা সভায় জমে উঠতোনা।
উপরোল্লিখত শ্রমিক নেতার বদলে (যিনি নিজেও শ্রমিক ছিলেন) একজন প্রাক্তন ছাত্রনেতা যিনি একসময় ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, কমিউনিষ্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু তখন রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন, যিনি নিজে বক্তৃতার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি মঞ্চে এসে বক্তৃতা দিলেন। কিন্তু শ্রমিক শ্রেনীর স্বার্থের কথা বলেননি। মনি সিংহের সেটিয়ো শুরুজের কাহিনীর কথা কেউই বলেন নি। শ্রমিক শ্রেনীর পার্টির প্রয়াত নেতার স্মরণ সভায় শ্রমিক শ্রেনীর স্বার্থের কথা বলা হয়না। উচ্চারন করা হয়না বর্তমানে শ্রমিক শ্রেনীর অধিকার আদায় ও সংরক্ষনের কথা বলা হয় না এত শ্রমিকগণ নিজেদেরকে অপাংক্তেয়, অনুল্লেখ যোগ্য ও কোন কান ক্ষেত্রে অপমানিত বোধ করেন।
বরং শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানের অন্যতম সংগঠিক, ঢাকা নগর পূজা কমিটির অন্যতম নেতা, প্রাক্তন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা বেকায়দায় পড়া অনুপস্থিত ভূস্বামী এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী অত্যন্ত আবেগময় ভাষার কমরেড মনি সিংহের নামে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম করন করার জোরালো দাবী উত্থাপন করেন। সকলেই তাকে হাত তালি দিয়ে সমর্থন জানান।
অনুপস্থিত মালিক, বর্গমালিক আর যোতদারের খুব খুশিতে মনি সিংহের মূল্যায়ন করাতে নিজেরও বিমুগ্ধহন। মনি সিংহের স্মৃতিকে ধরে রাখতে “জমি চোর” যোতদারদের প্রচেষ্টাও স্মরণীয় হয়ে থাকে।
কিন্তু অনুচ্চারিত থাকে কৃষকের জমি পাওয়ার আকাংখা। বাংলাদেশে যে কয়জন ব্যক্তি বাঙ্গালিদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অবদান রেখেছেন মনি সিংহ তাদের মধ্যে অন্যতম কি ব্যক্তিগত আচরনে। কি রাজনৈতিক সংগ্রামে, দৈনন্দিন রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে ইত্যাদি সকল কিছুর মধ্যে দিয়ে তার গণতান্ত্রিক চেতনা বোধ সকল সময়েই ইস্পাতের তলোয়ারের মত নির্ধারক ভূমিকা পালন করত। টংক প্রথা বিরোধী আন্দোলনের পরে পাকিস্তান সরকারের রেম নিপীড়নের পরিবেশে পূর্ব বাংলা ত্যাগ না করে এখানেই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সাহসিক সিদ্ধান্ত তার দৃড়চেতনা মানসিকতার পরিচয়। (নিজের ছেলের সাথে মুসলিম মেয়ের বিয়ে।) মনি সিংহ আহমদ শরীফ, সিরুজ সিকদার, চারু মজুমদারের নাম বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্নাক্ষরে লিখে রাখার কোন প্রয়োজন নেই কারন নামগুলো আপন আলোতেই উজ্জ্বল।