জন্মের পর থেকে শিক্ষা গ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়ে বহু শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসেছি। সেই শিক্ষাগুরু যারা আমার ভেতর জ্ঞানের সঞ্চার করেছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। সেই সব অনেক শিক্ষকের কথা আমার আজ মনে নেই। বাবা-মা’র পর শিশুর মনে ইতিবাচক পরিবর্তন করতে পারেন যে ব্যক্তি তিনি শিক্ষক। শিক্ষকের স্থান তাই বাবা-মা’র পরেই। তবে মা হলো সন্তানের প্রধান এবং প্রথম শিক্ষক। পরিবারের সব সদস্যই কোনো না কোনোভাবে শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে থাকেন। কারণ জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তারা নৈতিকতার পাঠ দেন। আজ যে শিক্ষার অভাব প্রকট। এই সমাজ ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনতে যদি কেউ সক্ষম হন তিনি শিক্ষক। শিক্ষকতা কোন পেশা নয় বরং এটি একটি ব্রত। কোনো কোনো শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব ছাত্রের জীবনে প্রভাব ফেলে। ছাত্র সেই শিক্ষকের আদর্শ অনুসরণ করে এবং তার প্রিয় শিক্ষকের মতো হতে চায়। শিক্ষকের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সে তার জীবনের লক্ষ্য স্থির করে নেয়। কোনো কোনো শিক্ষকের কথা ক্লাসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে ছাত্রছাত্রীরা। আমিও শুনেছি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে বেশি ঘনিষ্টতা ছিল না। কারণ এখন যেমন বিদ্যালয়ে প্রহার করা নিষেধ তখন এমনটা ছিল না। অধিকাংশ শিক্ষকের হাতেই মোটা মোটা বেত দেখেছি। ফলে এক রকম ভয় নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পার করেছি। আজ নিজে শিক্ষক হয়ে বুঝতে পারি শিক্ষকের সাথে দুরত্ব আসলে ছাত্রছাত্রীর লেখাপড়াকে বিঘিœত করে। সে শিক্ষকের কাছে যা জানতে চায়, শিখতে চায় তা সে শিক্ষককে জিজ্ঞেস করতে ভয় পায়। মাধ্যমিকে এসে শিক্ষক সম্পর্কে আমার ধারণা একটু পরিবর্তন হলো। এখানে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থাকলেও কিছু শিক্ষক ছাত্রছাত্রীকে কাছে টানতে পারতেন। এর মধ্যে ইংরেজির শিক্ষক রাজ্জাক স্যারের কথা না বললেই নয়। আমি যখন পরবর্তিতে এই স্কুলেই শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি তখন এই স্যারের সাথেই কাজ করার অভিজ্ঞতা পেয়েছি। যাদের ছাত্র জীবনে প্রচন্ড ভয় পেতাম দেখেছি মানুষ হিসেবে তারা কত সহজ। দেখেছি সবসময় ছাত্রছাত্রীর মঙ্গল চিন্তা করতেন। হয়তো সেসময় আমরা শিক্ষকদের সেই মানবিকতা বুঝতে অক্ষম ছিলাম। কিন্তু তাদের কাঠিন্যের ভেতর কমলতা, রাগের ভেতর আদর থাকতো।
তাই এতদিন পর যখন আমি শিক্ষক হয়েছিল তখন সেই শিক্ষকদের শাস্তির কথা একটুও মনে নেই। মনে আছে কেবল তাদের ভালোবাসাটুকু। মাধ্যমিকে আমি যে প্রধান শিক্ষক পেয়েছি, সেই প্রধান শিক্ষকের অধীনেই শিক্ষক হয়ে চাকরি করেছি। দেখেছি, যাকে দেখলে স্কুলের সব ছাত্রছাত্রী ভয়ে কাঁপতো, সেই মানুষটি আসলে একদম সহজ,সরল মানুষ। তবে শিক্ষকের ধারণা আমার বদলেছে কলেজ থেকে। কলেজ জীবনে ইংরেজিও ওহাব স্যার (কয়েকদিন আগেই তিনি মারা গেছেন) আর অনার্স জীবনের মাহবুব স্যারের কাছ থেকে শিখেছি শিক্ষকও ছাত্রছাত্রীদের বন্ধু হতে পারে। আমার শিক্ষকদের কেউ কেউ আজ পৃথিবীতে নেই। তবে মনে পরে খুব। আমি যখন শিক্ষকতা পেশায় আসি তখন সবেমাত্র অনার্স শেষ করেছি। প্রথম যোগদানও করি আমার সেই চেনা, আমার প্রিয় সেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। সেই প্রধান শিক্ষক, সেই সব সহকারী শিক্ষকদের সাথেই আমার শিক্ষকতার জীবন শুরু করি। এই অনূভুতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। স্কুলের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনার সুবাদে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্টতা ছিল আমার প্রিয় ইংরেজির শিক্ষক রাজ্জাক স্যারের সাথে। দু’জনের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আমরা পরপর তিন বছর দেয়াল পত্রিকা বের করেছিলাম। কত সময় দুজনে শিক্ষকতা নিয়ে আলোচনা করেছি তার হিসাব নেই। কি নিষ্ঠার সাথে একটি কাজ করা যায় তা শিখেছিলাম দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়ে। তবে বিরুপ অভিজ্ঞতা হয়েছে পাবলিক পরীক্ষায় কক্ষ পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করার সময়। কিছু কিছু অভিভাবকের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ আমাকে একই সাথে অবাক এবং ক্ষুদ্ধ করেছে। পরীক্ষার আগে নিজের সন্তানকে নিয়ে আমার কাছে হাজির হয়ে পরীক্ষার হলে সাহায্য করা, সুযোগ দেয়ার আবদার করেছে অনেকে। বলতে দ্বিধা নেই এর মধ্যে অনেক শিক্ষকও ছিলেন। নিজের প্রাইভেট পড়ানো ছাত্রছাত্রীর ভালো রেজাল্ট করাতে এরকম অন্যায় আবদার আমাকে বহু শুনতে হয়েছে। আমাকে কব্জা করতে না পেরে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করার চেষ্টাও করা হয়েছে। হুমকিও শুনেছি অনেক। আমিও প্রচুর প্রাইভেট পড়েছি। এইসব শিক্ষকের কাছেই পড়েছি।
কোনোদিন দেখিনি আমার শিক্ষকরা প্রাইভেটের ছাত্রছাত্রীকে পরীক্ষার হলে নূন্যতম অনৈতিক সাহায্য করেছে। পারতপক্ষে চিনতেও পারেনি। আর এখন প্রাইভেটের ছাত্রছাত্রীর জন্য অন্যায় আবদার করতেও অনেকে পিছুপা হয় না। এটা স্পষ্ট নৈতিকতার অবক্ষয়। তবে আজ পর্যন্ত শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় অনেক অল্ম মধুর স্মৃতি রয়েছে। তখন আমি শিক্ষক হিসেবে একদম নতুন। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠিত হ্েচ্ছ। শিক্ষকদের জন্যও কয়েকটি ইভেন্ট ছিল। আমি কোনোটাতেই ভালো করতে পারিনি। শেষে পুরুষ্কার বিতরণের পালা। আমি ছিলাম সবার জুনিয়র। ফলে আমি সবার শেষে সান্তনা পুরষ্কার নিতে গেলাম। যখন শ্রদ্ধেয় ইউএনও স্যারের হাত থেকে যখন পুরষ্কার নিচ্ছি সেই সময় সারা স্কুলের ছাত্রছাত্রী সবাই একসাথে করতালি দিতে লাগলো। ইউএনও স্যার আমাকে জিজ্ঞ্যেস করলেন, আপনি যখন পুরষ্কার নিচ্ছেন তখন এত করতালি দিয়ে আনন্দ করছে কেন? আমি বললাম, স্যার ওরা আমাকে খুব ভালোবাসে, তাই। আমার দু’চোখ তখন ভিজে আসছিল। পুরষ্কার হাতে নিয়ে নেমে এলাম। এরকম কিছু ঘটনা অনেকবারই ঘটেছে। আজ অনেক ছাত্রছাত্রী রাস্তায় দেখলেই তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করে। সত্যি কথা বলতে শিক্ষকতা পেশায় অনেক অপূর্ণতা রয়েছে। কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে অনায়াসে সেই পূর্ণতা দূর করা যায়। অনেক চাওয়া থাকলে এই পেশায় আসা সমীচীন নয় বলেই আমার মনে হয়। তবে যদি ভালোবাসা চান তবে এই পেশার থেকে আর কোনো পেশা উত্তম হতেই পারে না। শিক্ষক বেঁচে থাকেন শিক্ষার্থীর মধ্যে। মানুষ হওয়ার সেই মন্ত্র একমাত্র শিক্ষকের ভেতরেই থাকে। শিক্ষকতা সত্যিকার অর্থেই একটি গর্বের বিষয়। এই গর্বটুকু নিয়েই আজীবন শিক্ষকতা করে যেতে চাই।
অলোক আচার্য
শিক্ষক ও কলামিষ্ট পাবনা।