পানিসম্পদ খাতের নদীর তীর সংরক্ষণ কাজের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। বছর ঘুরতেই লাফিয়ে লাফিয়ে এ ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ছে। অভিযোগ রয়েছে, নদীর তীর সংরক্ষণ কাজের ব্যয় নিয়ে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। ফলে ওসব প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে খোদ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়েরই আপত্তি থাকে। লক্ষ্মীপুর জেলায় মেঘনা নদীর অংশে তীর সংরক্ষণে প্রতি কিলোমিটারে ১০০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। যা চলমান প্রকল্পের চেয়ে এই ব্যয় অনেক বেশি। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি ও কমলনগর উপজেলাধীন এলাকায় ভাঙন থেকে রক্ষা করতে মেঘনা নদীর তীর সংরক্ষণে ৩ হাজার ১৯৭ কোটি ১২ লাখ ৭২ হাজার টাকা ব্যয়ের প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়। সেখানে ৩০ দশমিক ৮১৩ কিলোমিটার তীর সংরক্ষণ করার কথা। মেঘনা নদীর বামতীর বরাবর ভাঙনকবলিত প্রায় ৩১ কিলোমিটার স্থায়ী প্রতিরক্ষা কাজ বাস্তবায়নের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি ও কমলনগর উপজেলাধীন কৃষি জমি, স্কুল, কলেজ, বাজার, মাদরাসা, সড়ক, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অবকাঠামো রক্ষা করা। প্রতি বছর ওই এলাকায় ২৫০ থেকে ৩০০ মিটার নদীভাঙন হয়। প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর এলাকা জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের পানি প্রবেশ রোধ এবং নদীর তীর সংরক্ষণ করা। তাছাড়াও প্রকল্পে কাজের মধ্যে রয়েছে ১২৮টি পর্যটক বেঞ্চ বা বৈঠকখানা নির্মাণ, ১৫টি আউটরেট নির্মাণ এবং ১৫টি ঘাটলা নির্মাণ করা। অনুমোদন পেলে ৩ বছর ৯ মাসে প্রকল্পটি সমাপ্ত করার কথা রয়েছে।
সূত্র জানায়, নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের ব্যয় বিভাজনে দেখা যায়, ৩০ দশমিক ৮১৩ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ১০১ কোটি চার লাখ ৭৯ হাজার টাকা। তাতে প্রতি কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণে খরচ হবে ১০০ কোটি ৬৪ লাখ ৮ হাজার টাকা। যা চলমান প্রকল্পের চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নদীর তীর সংরক্ষণে এতো ব্যয়ের কোনো তথ্য নেই। তীর সংরক্ষণ কাজ ৩৪টি প্যাকেজে বিভক্ত করা হয়েছে। নদীর তীর সংরক্ষণে চলমান অন্য প্রকল্প বিশ্লেষণে দেখা যায়, সিরাজগঞ্জের প্রকল্পে ৪ কিলোমিটার যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪১ কোটি ৭৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা। যেখানে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হবে ৬০ কোটি ৪৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। আর গাইবান্ধায় একই ধরনের অপর প্রকল্পে যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণ ব্যয় ধরা হয়েছে প্রতি কিলোমিটার ৩৯ কোটি ৬৭ লাখ ১১ হাজার টাকা। আর ঢাকা জেলার দোহার উপজেলাধীন মাঝিরচর থেকে নারিশাবাজার হয়ে মোকসেদপুর পর্যন্ত সাড়ে ৭ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ করার প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। যাতে ব্যয় হবে ৭৭৯ কোটি ২১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে শুধু তীর সংরক্ষণ কাজে ব্যয় হবে ৬১০ কোটি ৫৪ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। ফলে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। আর চলামন চট্টগ্রাম জেলার হালদা নদীর বিভিন্ন স্থানে তীর রক্ষার ১৩ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার কাজের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ২৩৯ কোটি দুই লাখ টাকা। সেখানে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ১৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
সূত্র আরো জানায়, নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রাক্কলন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নতুন রেট শিডিউল ধরে করা হয়েছে। যার কারণে চলমান প্রকল্পের চেয়ে খরচ বেশি হবে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্যাকেজের কাজ যথাসম্ভব পরিহার করা জরুরি। ডিপিপির সার্বিক ক্রয় পরিকল্পনায় নদী তীর সংরক্ষণ কাজ একাধিক প্যাকেজে বিভক্ত করা হলেও সংশ্লিষ্ট কাজের মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের ভিত্তিতে আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আদেশ অনুযায়ী ক্রয়চুক্তি অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হয়। তাছাড়া ডিপিপিতেও অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। কারণ ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে প্রকল্পে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ৩ হাজার ১৯৭ কোটি টাকার এই প্রকল্পে পরিপূর্ণভাবে সমীক্ষা করা হয়নি। সম্ভাব্যতা সমীক্ষার গ্রহণযোগ্যতার জন্য পানিসম্পদ সেক্টরের অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি হালনাগাদ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পাদন করা যেতে পারে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) মো: জাকির হোসেন আকন্দ জানান, পাউবির নতুন রেট শিডিউল ২৫ শতাংশ বেশি ধরে করা হয়েছে। ফলে ব্যয় বাড়ছেই। তাছাড়া আগে বা চলমান প্রকল্পগুলোতে যে ব্লক তৈরি করা হয় তাতে সিমেন্ট ও কংক্রিট যে রেশিওতে দেয়া হয়, তাতে সাত-আট বছর অতিক্রম করলেই ওই সব ব্লকের চামড়া উঠে যায়। এখন আগের চেয়ে ব্লকগুলো অনেক বেশি মানসম্পন্ন ও বড় আকারের করা হচ্ছে। সব ব্লক আরো আধুনিক হবে। কারণ নদীর পানি কৌশলে ব্লকের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ফলে আস্তে আস্তে ব্লকের নিচ থেকে বালু সরিয়ে দেয়। তারপর এমনিতেই ব্লকগুলো সরে যায়। তবে এখন যেভাবে করা হচ্ছে তা অনেক আধুনিক।