ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে পরষ্পর সংযুক্ত বিশ্ব নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে আজ মরিয়া।কিন্তু এ বিচ্ছিন্নতার পরিণতিতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে লড়াই আরো কঠিন হবে। এই মুহূর্তে আমাদের এক সঙ্গে বড় দুইটি সংকটের মধ্যদিয়ে যেতে হচ্ছে। এক, করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর রূপ নেওয়া; দুই, এর ফলে বিশ্বজুড়ে আর্থিক ও অর্থনৈতিক যে দুর্যোগ ঘনিয়ে উঠেছে তা। বলা যায়, করোনা ভাইরাস সংকট কেটে যাওয়ার পর অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলার লড়াই হবে আরো কঠিন। যা নিয়ে সারাবিশ^ আজ অস্থির। বিশে^র নেতারা ছুটে চলেছেন এদিক-সেদিক।
বিশে^র এই ক্রান্তিকাল সময়ের মধ্যেই শুরু হয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৫তম অধিবেশন। সাইডলাইনে ভার্চুয়াল জীববৈচিত্র্য বিষয়ক এই সম্মেলনে সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা নিজেদের সঙ্কট উত্তরণে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করে যখন একের পর এক বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন ঠিক তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ^নেতাদের দেখালেন নতুন এক সম্ভাবনাময় পথ। বিশ^ব্যাপী করোনা মহামারিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে বিশে^র ছোট-বড় সকল রাষ্ট্রকে রক্ষায় চার দফা প্রস্তাবনা উত্থাপণ করলেন শেখ হাসিনা। এছাড়াও বিনিয়োগের সময় টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার আহ্বানও জানান প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর এই আহবান এবং চার দফা প্রস্তাবনায় যেনো নতুন পথ খুঁজে পেয়েছেন বিশ^ নেতারা এমনটাই মন্তব্য করা একাধিক রাষ্ট্রপ্রধানদের করা মন্তব্য উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম লিখেছেন কলাম, সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়।
প্রথম প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন, পৃথিবী এবং আমাদেরকে রক্ষার জন্য বিনিয়োগের সময় আমাদের টেকসই ভবিষ্যতের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। টেকসই উন্নয়নের জন্য জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ শীর্ষক এ ইভেন্টে প্রধানমন্ত্রী তার দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থা ও গবেষণার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বৃহত্তর গণসচেতনতা সৃষ্টি ও জাতীয় পর্যায়ে আইন-কানুন জোরদার করা এবং নিরীক্ষণ প্রক্রিয়া জীববৈচিত্র্য রক্ষার মূল পদক্ষেপ।
তিনি তার তৃতীয় প্রস্তাবে উল্লেখ করেন, জেনেটিক রিসোর্স এবং ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের প্রকৃত মালিকদের জন্য বিশ্বব্যাপী সুফল বাটোয়ারায় প্রবেশাধিকার অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। আর চতুর্থ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্যারিসের (সনদ) লক্ষ্য অর্জন আমাদের বিলুপ্তি এবং টিকে থাকার মধ্যে পার্থক্য তৈরি করতে পারে। আমাদের অবশ্যই সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নের জন্য জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ এর ব্যাপারে সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা একটি আন্তঃনির্ভরশীল বিশ্বে বাস করি যেখানে পৃথিবী গ্রহের প্রতিটি প্রজাতি আমাদের বাস্তুসংস্থানে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশ মিঠা পানির ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিঠা পানির জীববৈচিত্র্য বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুত হারে হ্রাস পাচ্ছে, বৈশ্বিক জলাভূমির ৮৫ শতাংশ এরইমধ্যে শিল্প বিপ্লবের পরে হারিয়ে গেছে। ১৯৭০ সাল থেকে মিঠা পানির স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, উভচর, সরীসৃপ ও মাছের সংখ্যা প্রতি বছর গড়ে ৪ শতাংশ হারে হ্রাস পেয়েছে। তিনি বলেন, আমরা জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ক্ষতি আশঙ্কাজনকভাবে বাড়িয়ে তুলছি এবং ফলস্বরূপ, কোভিড-১৯ এর মতো ‘জুনটিক’ (প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত) রোগের ঝুঁকি বেড়ে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, আমাদের বর্তমান ক্রিয়াকলাপ অব্যাহত রাখা হলে আমরা কেবল অন্যান্য প্রজাতির বিলুপ্তির কারণই হচ্ছি না, মূলত আমরা মানবজাতিরও চূড়ান্ত বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাব।
উল্লেখ্য, জৈব বৈচিত্র্য সম্পর্কিত কনভেনশন বাস্তবায়নের জন্য আইন-প্রণয়নকারী অল্প কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আমাদের সংসদ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ বায়োলজিকাল ডাইভারসিটি অ্যাক্ট ২০১৭ পাস করেছে, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার দেশের মোট স্থলভাগের ৫ শতাংশেরও বেশি এবং সামুদ্রিক জলভাগের প্রায় ৫ শতাংশ অঞ্চলকে সংরক্ষিত ও পরিবেশগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ঘোষণা করেছে।
জীববৈচিত্র্য রক্ষা না পেলে পুরো মানবজাতিই বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাবে মন্তব্য করে এই পৃথিবী ও মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বক্তব্য রাখার পরপরই বিশে^র বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স গণমাধ্যমে বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় ব্যাপক আলোচিত হয়। বলা হয় বিশ^ যখন অস্তিত্ববিলীনের শঙ্কায় তখনও উন্নত বিশে^র নেতারা নিজেদের দাম্বিকতায় ব্যতি-ব্যস্ত। যখন সীমান্ত সঙ্কটসহ অভ্যান্তরীন নানা ইস্যুতে কথা বলছেন বিশ^নেতারা তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর চার প্রস্তাবনা বিশ^বাসীকে নতুন স্বপ্নের পথ দেখিয়েছে।
গভেষকদের মতে, করোনার কারণে তৃতীয় আরেকটি সংকটও তৈরি হয়েছে। যেটা অবশ্যই আগের দুইটির সঙ্গে সংযুক্ত। সেটা হলো ‘সামাজিক দূরত্ব' বজায় রাখতে পারা। করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে সব দেশই জনগণকে ভিড় এড়িয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছে। সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর মানুষ অসহায়বোধ করে। এ অবস্থা কাটাতে নানা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যে বই পড়বো-পড়বো বলে পড়া হয়ে উঠেনি সেগুলো পড়া, সিনেমা দেখাসহ নানাভাবে অস্বস্তিকর এ সময় পার করতে বলা হচ্ছে। অবরুদ্ধ এ অবস্থায় যখন সবাই নিজ নিজ ঘরে বন্দি তখন একে অন্যকে সাহস যোগাতে আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে দেখেছি প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। যেমন গত সপ্তাহে ইতালীয়রা নিজেদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বা জানালা খুলে গান গেয়ে একে অন্যকে উৎসাহিত করেছেন। বাংলাদেশে এর উল্টো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীর উদ্দেশ্যে টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে প্রণোদনা ঘোষণা করে সাধারণ মানুষের মনে স্বস্থি এনে দেন। শুধু তাই নয়, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি, মাঝারি ব্যবসায়ি, শিল্পপতি, সরকারি বে-সরকারি চাকরীজীবিসহ সব শ্রেণী পেশার মানুষকে এই মহামারি রোধ করে নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা যগিয়েছে।
তারপরও কিছু সঙ্কট তৈরি হচ্ছে প্রাকৃতিক নিয়মেই। যেমন সম্প্রতি বিশ্বের পানি সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের এমন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ফ্রান্সের বার্তা সংস্থা এএফপি, যেখানে উঠে এসেছে আফ্রিকা ও বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের চিত্র। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে পানি সংকট এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কর্তৃপক্ষ বলছে, খুব সহসাই ডে জিরো বা যে দিন থেকে শুধু জরুরি প্রয়োজনে পানি সরবরাহ সম্ভব, সে দিনটি এসে যেতে পারে। খুব শিগগিরই বাসাবাড়ির ট্যাপে পানি হয়তো আর থাকবে না। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হারে কমে যাচ্ছে ভূগর্ভের পানির স্তর। বলা হচ্ছে, এসব ঘটনা জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেবার জন্য ঘটেনি। এসব কারণ হয়তো পরে যোগ হয়েছে। কিন্তু এগুলো ঘটছে অনেক আগে থেকেই। যা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক নিয়মেই হয়ে আসছে।
২০১৫ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্টে পানি সংকটকে বৈশ্বিক হুমকির তালিকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শরণার্থী সংকট ও সাইবার আক্রমনের ওপরে স্থান দেয়া হচ্ছে। কানাডার ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরেটাস গ্রাহাম কোগলি বলেন, ইন্দো-গাঙ্গেয় সমতলে, অর্থাৎ, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রায় ৬০ কোটি মানুষের বাস, খুবই অনিয়ন্ত্রিত ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ হারে মাটির নিচের পানি তুলে ফেলা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, এই বেসিনের ভূ-গর্ভস্থ পানির প্রায় অর্ধেক আবার ব্যবহারের অযোগ্য। কারণ, এতে লবণাক্ততা ও আর্সেনিকের মাত্রা অনেক বেশি। তাই এগুলো পান করা বা কৃষিকাজে ব্যবহারের অনুপযোগী।
ভূ-গর্ভস্থ পানি অন্তত বিশ্বের ৫০ ভাগ পান করা ও ৪০ ভাগ কৃষিতে ব্যবহারের জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সেই পানি প্রাকৃতিকভাবে মাটির নিচে একই হারে সেসব ভূগর্ভস্থ অ্যাকুইফায়ারে যুক্ত হয় না, যেমনটা বৃষ্টিতে মাটির উপরিভাগের জলাশয়ে ভরাট হয়। তাই ভূ-গর্ভস্থ পানিকে আর নবায়নযোগ্য বলা যায় না। দ্য ওয়ার্ল্ডস ওয়াটার' বইয়ের লেখক পিটার গ্লাইক এএফপিকে বলেন, মানুষ যেভাবে সময়ের আগেই এসব পানি ব্যবহার করে ফেলছে, তাতে এই পানি এখন অনবায়নযোগ্য হয়ে গেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখানেই থামতে রাজি নন। তিনি তৈরি করেছেন একাধিক পথ। দেশের মানুষের কাছে সুপেয় পানি পৌঁছে দিতে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমিয়ে মাটির উপরের পানির ব্যবহার বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য আমাদের দেশের মানুষকে সুপেয় পানি দিতে হবে। কিন্তু আমাদের ভূ-উপরস্থ পানি ব্যবহার করতে হবে। আমাদের সেচের পানি বা ব্যবহারের পানির জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানির পরিবর্তে আমরা যেন ভু-উপরস্থ পানি ব্যবহার করতে পারি, সেদিকে আমরা বিশেষ দৃষ্টি দিই।
শেখ হাসিনা বলেন, যে পানির জন্য এক সময় হাহাকার ছিল, সেই হাহাকারটা যেন বন্ধ হয়। পাশাপাশি সারা বাংলাদেশে যত খাল, বিল, হাওড়, পুকুর, নদী যা আছে সবগুলোতে যাতে নাব্যতা থাকে সেগুলো খনন করে পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো। তাতে দুটি কাজ হবে। একটা হচ্ছে আমাদের জীববৈচিত্র্য রক্ষা হবে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা হবে, আবার মৎস্য উৎপাদন বাড়বে। মানুষের চহিদাটাও আমরা পূরণ করতে পারব। সেদিকে লক্ষ্য রেখে বিভিন্ন পরিকল্পনা আমরা হাতে নিয়ে সেগুলো আমরা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। বাস্তবেও যেনো আমরা তাই দেখছি। একের পর এক উন্নয়নন প্রকল্পের মাধ্যমে সুপেয় পানির যথাযথ ব্যবস্থা করা, আর্সেনিক প্রতিরোধ ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় সফলতার দারপ্রান্ত্রে এসে দাড়িয়েছেন টানা তৃতীয়বারের ন্যায় ক্ষমতায় থাকা সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
লেখক : এম. শাহজাহান, সাংবাদিক