ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংস অপরাধের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ধর্ষণের প্রবণতা কেন রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না, তা এক গভীর প্রশ্ন। সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিন অনেক ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হচ্ছে, প্রকাশিত হচ্ছে না এমন ঘটনার সংখ্যা কত হতে পারে, তা অনুমান করাও সম্ভব নয়। তবে নিশ্চিতভাবেই অনুভব করা যাচ্ছে, এই সমাজ পুরোনো ও দুরারোগ্য ব্যাধির মতো ধর্ষণপ্রবণতা বয়ে চলেছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) দেওয়া তথ্য মতে, চলতি বছরে জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৮৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আর ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৪১ জন। প্রতিমাসে গড়ে ১১১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
সম্প্রতি সংস্থাটির দেয়া এ পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা যায়, দেশে ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন বাড়ছে। ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন। আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ নারী। এছাড়া ২০১৮ সালে ৭৩২ জন এবং ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ নারী।
সেদিন ৫ জানুয়ারী ২০২০ রবিবার। অনলাইনে ভাইরাল হচ্ছে একটি খবর। পরবর্তী দিন সকল খবরের কাগজে প্রতিবেদন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস থেকে নামার পর ঢাবি'র দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। রবিবার বিকেলে রাজধানীর কুর্মিটোলা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটার দিকে শেওড়া যাওয়ার উদ্দেশে ঢাবির বাসে ওঠেন ওই শিক্ষার্থী। সন্ধ্যা ৭টার দিকে কুর্মিটোলায় বাস থেকে নামার পর অজ্ঞাত ব্যক্তি তার মুখ চেপে তাকে পার্শ্ববর্তী একটি স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে অজ্ঞান করে ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়। পরে রাত ১০টার দিকে জ্ঞান ফিরলে তিনি নিজেকে পান নির্জন স্থানে । পরে সেখান থেকে সিএনজি যোগে নিজ গন্তব্যে পৌঁছালে তাকে রাত ১২টার দিকে ঢামেক হাসপাতালের ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারে ভর্তি করা হয়। তারপরের ঘটনা সকলেরই জানা। অনেকে যাবেন, অনেক কথা বলবেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করবেন এটাই বর্তমান সময়ের সাধারণ ঘটনা। ঘটনাটা শুনে অবাকই হলাম। কিছুদিন আগে প্রায়ই শিশু ধর্ষনের অভিযোগ বা ঘটনা ঘটছিল। তখনও ঠিক একই রকম অবাক হয়েছিলাম। কি হচ্ছে এসব বার বার প্রশ্ন জাগত মনে? মনে হতো মানুষ এত অমানবিক বা হিং¯্র হয় কি করে? ছোট্ট মেয়েকে এগুলো করে কোন রুচিতে? মনে হতো এই শিশুরা কত অসহায়? তারা কি জানে বাইরের পরিবেশ এত নোংড়া? বাইরে গেলে কি হতে পারে ওরা কি জানত? এত কম বয়সে জানার কথাও অবশ্য না। তখন মনে হয়েছিল শিশুদের বাইরে আর একা পাঠানো ঠিক হবে না। কারণ বাইরে মানুষরূপী অমানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে। কিন্তু রবিবার যখন ঢাবি'র দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন খবরটি দেখলাম তখন নিজেই যেন হতবাক হয়ে গেলাম। এখন কি করা উচিত? একটি শিশু না হয় বোঝে না সে অসহায় তাই তাকে নিয়ে এমন হয়েছিল কিন্তু একজন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী যখন ধর্ষিত হচ্ছে তাহলে পরিবেশটা কোথায় যাচ্ছে? একটি পরিবার কতটা নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছে? শিশুকালে না হয় অভিভাবক হিসেবে বাবা-মা সাথে থাকবে। কিন্তু কলেজে পড়া মেয়েদের সাথে বাবা-মা যাওয়া ঠিক হবে? তারা কি যেতে পারবে? তাদের কোন না কোন কর্ম রয়েছে? তাদের পরিবারে বৃদ্ধ কেউ রয়েছে? তাদের অন্যান্য সন্তান-সন্তানদি রয়েছে। তাহলে কে কাকে কিভাবে দেখাশোনা করবে? সর্বশেষ সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় বার বার সেই অন্ধকার যুগের কথায় মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে বেগম রোকেয়ার আন্দোলন সঠিক ছিল না। মনে হচ্ছে নারীদের ঘরে বাইরে যাওয়া নিরাপদ নয়। আমার বিশ্বাস এই ঘটনার পর অনেকে তেমনটাই ভাবছে। কিন্তু সত্যি কি ধর্ষকের ভয়ে নারীদের ঘরে থাকতে হবে? ধর্ষকের দায়ে কি নারীরা পিছিয়ে থাকবে?
বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ ক্যাম্পাসে ধর্ষণ বা গণধর্ষণের অভিযোগ নতুন নয়। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলের ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগগুলো ওঠে। তারা এতটাই বেপরোয়া থাকেন যে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে এমনটি তারা মনে করেন না।
১৯৯৩ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের এক ছাত্রীকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করেন ছাত্রদল নেতাসহ কয়েকজন। পরিসংখ্যান বিভাগের সামনের জঙ্গলের মধ্যে তারা গণধর্ষণ করে। ঘটনার পর ছাত্রীর বাবাকে ডেকে সমঝোতা করে দেন। এ ঘটনায় ওই ছাত্রী ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যান; আর কোনো দিন তিনি ক্যাম্পাসে ফেরেননি। এমনকি ছাত্রীর বাবাও কাঁদতে কাঁদতে ক্যাম্পাস চত্বর ছাড়েন। এই ঘটনার পর ১৯৯৫ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের এক ছাত্রীকে অর্থনীতি বিভাগের সামনে থেকে প্রকাশ্যে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে আগের অভিযুক্ত ছাত্রদল নেতা । এই ঘটনায়ও তার কোনো বিচার হয়নি।
সময়টা ২০০০ সাল, থার্টি ফাস্ট নাইটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাঁধন নামে এক ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করা হয়। তখনও ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে তাকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ ওঠে। এরপর থেকেই থার্টি ফাস্ট নাইটে ছাত্রীদের হলের বাইরে আসা বন্ধ করা হয়। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও কোনো তরুণীকে থার্টি ফাস্টের প্রোগ্রামে অংশ নিতে দেওয়া হয় না।
এভাবে কি আসলে জীবন-যাপন সম্ভব? আমরা কতটা অনিরাপদের দিকে ধাবিত হচ্ছি? রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে একজন পিয়নের নিরাপত্তা দেবার দায়িত্ব সরকারের। তবে সরকারের একার পক্ষে কি সব নির্মূল করা সম্ভব? কি করলে সীমাবদ্ধতার মাঝে সঠিকভাবে করা সম্ভব তা নিরুপন করুন। কেন এই জঘন্যতম অন্যায়গুলো বেড়ে চলেছে তা নিরূপণ করুন ও ব্যবস্থা নিন। সরকার বলছে দেশ সুষ্ঠুভাবে চলছে। পুলিশ বলছে দেশের মানুষ নিরাপদে রয়েছে। তার মাঝেও যদি এমন তথ্য পাওয়া যায় তাহলে আমার মনে হয় নিরাপত্তা নিয়ে অনেকেই শংকিত হবে। তবে আমাদের সেই অনিরাপদের স্থানটি নিরাপদ করতে হবে। আমি মনে করি ধর্ষণ, খুন ও স্বাস্থ্যখাতের অপরাধ অমানবিক ও রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ। এগুলো জঘন্যতম কাজ যা সরকারকে বিপদগামী করে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অপরাধ এগুলো। তাই এই স্পর্শকাতর বিষয়গুলো বিচার দ্রুত ও কঠোর করা দরকার। কারণ বিচার হওয়ার পরও যখন ঘটনাগুলো ঘটছে তখন শাস্তিটা কঠিন হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। উপযুক্ত শাস্তি পেলে আমার মনে হয় ধর্ষকের উচিত শিক্ষা হবে। বাস্তবায়ন হবে ধর্ষকমুক্ত বাংলাদেশ। তাই আমি জোর দাবি জানাচ্ছি ধর্ষণ, খুন ও স্বাস্থ্যখাতের অপরাধগুলোর বিচার দ্রুত ও কঠোর করুন। জনসাধারণের মনে স্বস্তির জায়গা তৈরি করুন। আজ নারীরা সবক্ষেত্রে এগিয়ে। নারীদের কর্মের পরিবেশ ঠিক রাখতে, নারীদের এগিয়ে নিতে এই দুর্বল দিকগুলো সবল করা দরকার। না হলে এক সময় সেই আগের দিনে ফিরে যাবে। নারীরা আর ঘর থেকে বের হবে না। গাইবে না একসাথে জয়গান। বলা যাবে না নজরুলের সুরে, বিশ্বের যা কিছু চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট