রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ সরবরাহের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কাজ শেষ না করেই বাংলাদেশ ছেড়েছে ভারতীয় কোম্পানি ইএমসি। এমনকি ওই প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংকে জমা থাকা পারফরমেন্স গ্যারান্টির টাকাও তুলে নিয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী বিদ্যুৎ কোম্পানি কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে। আর এটি দেশের প্রথম কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মেগা প্রকল্প। ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি তাদের কাজ শেষ না করে যাওয়ায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ দুই বছরেরও বেশি সময় পিছিয়ে গেছে। বিদ্যুৎ বিভাগ এবং পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহে সরকার যে কয়টি লাইন নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করেছে তার একটি হচ্ছে মোংলা-খুলনা ২৩০ কেভি ডাবল সার্কিট ট্রান্সমিশন লাইন। সরকারি সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) ভারতীয় কোম্পানি ইএমসির নেতৃত্বাধীন ইএমসি-টিবিইএ যৌথ উদ্যোগকে (জেভি) এ কাজের জন্য নির্বাচিত করে। সেজন্য ইএমসি-টিবিইএর সঙ্গে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং মার্কিন মুদ্রায় ৮৫ লাখ ১৬ হাজার মার্কিন ডলার দেয়ার চুক্তি করে পিজিসিবি। চুক্তির আওতায় ভারতীয় কোম্পানি ইএমসি ও চীনা কোম্পানি টিবিইএ সঞ্চালন লাইনটির মালপত্র সরবরাহ, প্রয়োজনীয় খনন ও পরীক্ষণ এবং বাস্তবায়নের কাজ করার কথা।
সূত্র জানায়, বিগত ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পিজিসিবি ও ইএমসি-টিবিইএ’র মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী পরবর্তী ১৮ মাস অর্থাৎ ২০১৭ সালের জুনে সঞ্চালন লাইনটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা। কেন্দ্র থেকে খুলনার হরিনটানা সাবস্টেশন পর্যন্ত সঞ্চালন লাইনটির দৈর্ঘ্য ২৪ কিলোমিটার। তারপর দু’দফা সময়সীমা বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার কথা ছিল। কিন্তু কাজ শেষ না করে ওই বছরের অক্টোবর মাসে নির্মাণ কাজের নেতৃত্বে থাকা ইএমসি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়। এমনকি পিজিসিবিকে না জানিয়ে ইএমসি তাদের ঢাকা ও খুলনা অফিস বন্ধ করে দেয় এবং তাদের সব কর্মকর্তা ও প্রতিনিধি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান। ফলে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকে নির্মাণাধীন প্রকল্পের কাজ।
সূত্র আরো জানায়, দেড় বছরের কাজ দু’দফা সময়সীমা বাড়িয়ে ৩ বছর পর্যন্ত সময় নেয় ইএমসি-টিবিইএ। এই যৌথ উদ্যোগের নেতৃত্ব দেয় ইএমসি। কাজ এগোচ্ছিল না বলে পিজিসিবি কয়েক দফা তাদের তাগাদা দেয়। কিন্তু তাতেও কাজ কাক্সিক্ষত গতিতে সম্পন্ন হয়নি। আর ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের পাওনা পিজিসিবির কাছ থেকে বুঝে নিলেও স্থানীয় সরবরাহকারী-ঠিকাদারদের পুরো পাওনা বুঝিয়ে দেয়নি। এমনকি প্রকল্প শুরুর দিকে পারফরমেন্স গ্যারান্টি এবং ইএআর ইনসিওরেন্স হিসেবে ব্যাংকে জমা দেয়া চুক্তিমূল্যের ১০ শতাংশ (৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা এবং ৮ লাখ ৫১ হাজার মার্কিন ডলার) অর্থও তারা তুলে নিয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে ইএমসির সাড়া না পেয়ে ২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর পিজিসিবি চীনা কোম্পানি টিবিইএকে চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে পিজিসিবি বলে, প্রকল্পের পারফরমেন্স গ্যারান্টি (পিজি) এবং ইএআর (ইরেকশন অল রিস্কস) ইনসিওরেন্সের মেয়াদ যথাক্রমে গত ২৬ আগস্ট ও ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ হয়ে গেছে। এই পিজি ও ইএআর ইনসিওরেন্সের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য ইএমসিকে দু’বার চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইএমসি তাতে সাড়া দেয়নি। প্রকল্প এলাকায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না। পুরো কাজের ৭৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। ২৫ শতাংশ বাকি। ওই সময় পর্যন্ত ৯০ শতাংশ যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত সব পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে। চিঠিতে আরো বলা হয়, এটি পরিষ্কার যে ইএমসি লিমিটেড ইন্ডিয়া প্রকল্প কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি হিসেবে বাকি কাজ সম্পন্ন করে কাজটি সরকারকে বুঝিয়ে দেয়া টিবিইএর দায়িত্ব। কিন্তু ওই চিঠি এবং যোগাযোগের পরও প্রায় এক বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের আরো দুটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ পায় টিবিইএ। আর ভারতে ইএমসিকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়। এখন মোংলা-খুলনা ২৩০ কেভি ডাবল সার্কিট ট্রান্সমিশন লাইনের বাকি কাজ শেষ না করলে টিবিইএকে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে এবং দেশের অন্য কাজগুলোও বাতিল করা হবে এমন বার্তা দেয়ার পর টিবিইএ বাকি কাজ করে দিতে রাজি হয়। পরে গত বছরের নভেম্বরের শেষ দিকে তারা প্রকল্পের অসম্পন্ন কাজ শেষ করতে কাজ শুরু করে। সেজন্য নতুন করে ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তিও করে। কিন্তু আগের দেশীয় ঠিকাদারদের পাওনা এখনো মেটানোর ফলে দেশীয় উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছে।
এদিকে আগামী ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ প্রকল্পটি সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। অর্থাৎ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা তা দুই বছর দুই মাস পর শেষ হচ্ছে। যে কোম্পানি ইএমসির কারণে এই দেরি হলো তার বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ইএমসি কাজ অসম্পন্ন রেখে যেভাবে বাংলাদেশ ছেড়েছে, তা অশোভনীয় ও অন্যায়। একই সঙ্গে ব্যাবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকেও অনৈতিক। তাদের সঙ্গে পিজিসিবির করা পিজি এবং ইএআর ইনসিওরেন্সের মেয়াদ যখন শেষ হয়ে যায়, পিজিসিবির কর্মকর্তাদের তখনই ব্যাংককে জানানো উচিত ছিল। যাতে প্রকল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংকে রাখা টাকা যেন ইএমসি ওঠাতে না পারে। সে ব্যাপারে পিজিসিবি সতর্ক করতে পারতো। কিন্তু তা করা হয়নি করেনি।
অনএ প্রসঙ্গে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া জানান, এ নিয়ে তদন্ত হয়েছে এবং অনিয়ম ও গাফিলতি সম্পর্কে পিজিসিবির পরিচালকদের বোর্ড অবহিত আছে। বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী এখন কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। আর ইএমসি এখন দেউলিয়া হয়ে গেছে। তার পার্টনার টিবিইএর মাধ্যমে কাজ শেষ করানোর ব্যাপারেই পিজিসিবি মনোযোগী। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি নাগাদ এ সঞ্চালন লাইনের নির্মাণকাজ শেষ হয়ে যাবে। ইএমসির বাকি কাজ অংশীদার হিসেবে টিবিইএ এখন সম্পন্ন করছে। পিজি এবং ইএআর ইনসিওরেন্সের অর্থ টিবিইএ এখন জমা দিয়েছে এবং সেগুলো হালনাগাদ আছে।