৫ বছর আগেও ওরা ছিল পরাধীন। তাদের ছিল না নিজের পরিচয়, বাংলাদেশে লেখা-পড়া, চাকুরী কিংবা জমা-জমি কেনার কোন সামাজিক অধিকার। বাংলাদেশ ও ছিটমহলের এক ধরনের শোষক শ্রেনীর মানুষের কাছে তারা ছিল জিম্মি। পারতো না বাংলাদেশে এসে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। ভারতের বাসিন্দা হওয়া সত্বেও না পারতো ভারতে গিয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে। উপায় না পেয়ে কেউ কেউ জীবন ও জীবিকার তাগিদে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে পরিচয় গোপন করে অনেক কষ্টে চাকুরীতে যোগদান করলেও পরিচয় প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথেই খালি হাতেই বিদায় করে দিতো তাদের। দাসিয়ারছড়া ভারতের ভুখন্ড হলেও ভারতের সঙ্গে সংযোগ না থাকার কারণে এখানে ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রবেশ করতে পারত না। ছিটমহলের বাসিন্দারা নিয়ম শৃংখলা ঠিক রাখার জন্য -১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নিজেরাই এডহক কমিটি করে দাসিয়ারছড়ার মোট আয়তন ১ হাজার ৬৪৩ দশমিক ৪৪ একর এলাকা সীমানা নির্ধারন ও গঠনতন্ত্র তৈরি করেন। পঞ্চায়েত প্রথা চালু করেন তারা। গঠনতন্ত্রে দাসিয়ারছড়াকে দু‘ভাগে ভাগ করেন তারা। একটি হল-উজানটারী অপরটি ভাটিয়াটারী। এ দু'টি আবার ৩ মৌজায় ভাগ করা হয়। সে সময় দাসিয়ারছড়ার মোট ভোটার ছিল ১ হাজার ৯০০ জন। কিন্তু ভোটার তালিকায় শুধু পুরুষরাই ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারত। মহিলাদের ভোট ছিল না। গঠনতন্ত্রে আরও একটি বিষয় ছিল শুধু মাত্র উজান টারীর লোকরাই পঞ্চায়েত প্রধান পদে প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারতেন। কিন্তু ভাটিয়া টারীর লোকজন শুধু মাত্র ভাইস-চেয়ারম্যান পদে লড়তেন। পঞ্চায়েত প্রধান পদে নয়।
ছিটমহল আন্দোলনের নেতা মো. আলতাফ হোসেন, দাসিয়ারছড়ার সাবেক পঞ্চায়েত প্রধান নজরুল ইসলাম ও স্থানীয় বাসিন্দা আমজাদ হোসেন, মোজাফ্ফর রহমান, জহুর আলী জানান, ৬০ এর দশকে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য প্রধান কার্য্যালয় হিসাবে ২৫ শতাংশ জমিতে আইন ও শালিস ঘরটি (বোর্ড ঘর) প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওই ঘরটিতে বিচারক কক্ষ, সেমিনার কক্ষ ও আসামি রাখার কক্ষ নামে ৩ কক্ষ বিশিষ্ট ঘর নির্মান করা হয়। পরে দাসিয়ারছড়ার আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখার জন্য মোট ৯৪ জনের সমন্বয়ে ভিডি পার্টি (গ্রাম নিরাপত্তা বাহিনী) গঠন করা হয়। এদের মধ্যে ১ জন (উইন) কমান্ডার ও ৩ জন (সেক্টর) কমান্ডারের মাধ্যমে ভিডি পার্টি পরিচালিত হত। কেউ বিচারে দোষী সাব্যস্থ হলে তাকে ভিডি পার্টি দ্বারা ধরে এনে এই বোর্ড ঘরে আটকে রেখে বিচারকার্য পরিচালনা করতো দাসিয়ারছড়া পঞ্চায়েতের সদস্যরা। সেই কালের স্বাক্ষী ঐতিহাসিক আইন ও শালিস ঘরটি (বোর্ড ঘর) আজ বিলুপ্তির পথে প্রায়। এই ঘরটি সংস্কার করে সরকার সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে ভবিষ্যত প্রজন্ম এর প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারবে বলে জোর দাবী জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
৬৮বছরের অন্ধকার জীবন থেকে মুক্তি পাবার ৫ বছর অতিবাহিত হয়েছে বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়া বাসি। বহু ঘাত-প্রতিঘাত, সংগ্রাম লড়াই করে আজ আমরা স্বাধীন। বুক ফুলিয়ে বলতে পারি আমরা বাঙ্গালী, আমরা বাংলাদেশী।
উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ঐতিহাসিক ইন্দিরা-মুজিব স্থল সীমান্ত চুক্তিটি ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্য রাতে বাস্তবায়ন হওয়ায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরের ১১১টি এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল দুই-দেশের ভু-খন্ডে যুক্ত হয়। ফলে উভয় দেশের নাগরিক হবার সুযোগ পান অবরুদ্ধ ছিটমহলের বাসিন্দারা।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ অংশের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা খাঁন বলেন, আমরা বহু আন্দোলন করেছি দাসিয়ারছড়াকে আলাদা একটি ইউনিয়ন করার জন্য। কিন্তু তা হয়নি। এই বোর্ড ঘড়টি দাসিয়ার ছাড়ার বিচার ও আইন ব্যস্থার কালের স্বাক্ষী। আমি সরকারের কাছে জোর দাবী জানাচ্ছি বোর্ড ঘরটির সংস্কার পুর্বক সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক।