বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্যাডসর্বস্ব কোম্পানি টেকনোস্টিম এনার্জি নামের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে গিয়ে ফেঁসে গেছে। যার ফলশ্রুতিতে ফের সংকটের মুখে পড়েছে দেশের সর্ববৃহৎ ও সমৃদ্ধ গ্যাসক্ষেত্র তিতাস। এখন এর ‘লোকেশন-১’-এর ৭টি কূপের কম্প্রেসার স্থাপনে দ্বিতীয় দফার দরপত্র নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ প্রকল্পে প্রথম দফার দরপত্রে জাল-জালিয়াতি করে এমন প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৯৫০ কোটি টাকার কাজ দেয়া হচ্ছিল, যার তা বাস্তবায়নের সক্ষমতা নেই। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির অফিশিয়াল অস্তিত্বও ছিল না। তাতে ঝুঁকির মুখে পড়েছে বছরে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার গ্যাস উত্তোলন। কম্প্রেসার বসাতে না পারলে দৈনিক ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস তোলা বন্ধ হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি ভিগ্যাস দরপত্রের শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে। সবমিলে প্রকল্পের দাতা সংস্থা এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক (এডিপি) অসন্তুষ্ট। তারা বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির কাছে এসব বিষয়ের ব্যাখ্যা চেয়েছে। বিজিএফসিএল সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নানা অভিযোগে দীর্ঘদিন ধরে কম্প্রেসার বসাতে না পারায় তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাসের চাপ (রিজার্ভার প্রেসার) দ্রুত কমে যাচ্ছে। গ্যাসক্ষেত্রটির ‘লোকেশন-১’-এর ৫টি কূপের অবস্থা খুবই নাজুক অবস্থায়। স্বাভাবিক প্রাকৃতিক চাপে ওসব কূপ থেকে এক বছর পর্যন্ত গ্যাস তোলা সম্ভব হবে। তারপর দৈনিক ২০ কোটি (২০০ মিলিয়ন) ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাবে। যার আর্থিক মূল্য বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। সেজন্য কম্প্রেসার বসানো জরুরি।
সূত্র জানায়, গ্যাসক্ষেত্রে সময় মতো কম্প্রেসার বসাতে না পারার কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সেজন্য বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডের একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট দায়ি। ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা লোকেশন-১-এর ৫টি কূপে কম্প্রেসার বসানোর জন্য দরপত্র আহ্বানে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিজিএফসিএল শেষ পর্যন্ত প্রথম দফার দরপত্র বাতিল করে দ্বিতীয় দফায় দরপত্র দেয়। বিগত ৯ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দরপত্র উন্মুক্ত করা হয়। তাতে ৩টি কোম্পানি অংশ নেয়। অভিযোগ উঠেছে, বিজিএফসিএল এমন একটি কোম্পানিকে শর্ট লিস্ট করে, যে কোম্পানি দরপত্রে কারিগরিভাবে নন-রেসপন্সিভ। প্রথম দফার দরপত্রেও একই কারণে তারা নন-রেসপন্সিভ হয়েছিল। কিন্তু এবার তাদের রেসপন্সিভ করা হয়েছে। এটা নিয়ে তোলপাড় চলছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ইতিমধ্যে প্রকল্পের দাতা সংস্থা এডিপি বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডকে চিঠি দিয়েছে। তাতে এডিবি দরপত্রের ৭টি কারিগরি বিষয় সম্পর্কে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। অভিযোগ বিজিএফসিএল যে কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয়ার জন্য চূড়ান্ত শর্ট লিস্ট তৈরি করেছে ওই কোম্পানির দেয়া কারিগরি স্পেসিফিকেশনের সঙ্গে ৭ থেকে ১২টি টেকনিক্যাল প্যারামিটার কোয়ালিফাই করছে না।
সূত্র আরো জানায়, বিজিএফসিএলের শর্ট লিস্ট করা কোম্পানির কারিগরি দরপত্রকে নন-রেসপন্সিভ দাবি করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি ভিগ্যাস বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, টেন্ডারের শর্ত ছিল প্রক্রিয়া করা গ্যাস তেলমুক্ত রাখতে হবে। কিন্তু দরদাতা প্রতিষ্ঠানের কম্প্রেসারে তা সম্ভব হবে না। নন-লুব্রিকেটেড সিলিন্ডারসহ কম্প্রেসার দীর্ঘমেয়াদি ও নির্ভরযোগ্য ব্র্যান্ড। কিন্তু দরদাতা লুব্রিকেটেড সিলিন্ডারসহ এরিয়েল কম্প্রেসার প্রস্তাব করেছে। যা দরপত্রের শর্তের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাছাড়া দরপত্রে বলা হয়েছে, প্রতিটি সিলিন্ডারের প্রতিস্থাপনযোগ্য লাইনার থাকবে। লাইনারটির পুরুত্ব বহুলভাবে গৃহীত এপিআই-৬১৮ স্ট্যান্ডার্ডের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। কিন্তু দরদাতা প্রতিষ্ঠান এরিয়েল কম্প্রেসার প্রস্তাব করেছে। যার সিলিন্ডারে লাইনার নেই। এটিও দরপত্রের শর্তের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। চিঠিতে আরো বলা হয়, কম্প্রেসারের সর্বনি¤œ গড় পিস্টনের গতি ১৩ ফুট/সেকেন্ডের বেশি হবে না। পিস্টনের গতি পিস্টন রাইডার ব্যান্ডগুলোর হারকে সরাসরি প্রভাবিত করে। সেক্ষেত্রেও ওই দরদাতা কোম্পানি টেন্ডারের শর্ত পূরণ করতে পারেনি। দরপত্রে চারটি সিলিন্ডারসহ কম্প্রেসার প্রস্তাব করা হয়েছিল। সবকটি ডাবল কার্যক্ষমতাসম্পন্ন। চারটি সিলিন্ডারসহ বিজিএফসিএল কম্প্রেসারের জন্য কমসংখ্যক ফ্রেম এবং চলমান গিয়ার আহ্বান করেছিল। কিন্তু ওই শর্তও পূরণ করতে পারেনি ওই দরদাতা। তাছাড়া টেন্ডার স্পেসিফিকেশন শর্ত অনুযায়ী ওয়াটার কুলিং সিলিন্ডার অফার করা হয়েছিল। কিন্তু দরদাতা প্রতিষ্ঠান এয়ার কুলড সিলিন্ডার সরবরাহ করেছে, যা ওই দরপত্রের জন্য প্রস্তাবিত নয়।
এদিকে গ্যাসফিল্ড সংশ্লিষ্টদের মতে, এই গ্যাসক্ষেত্রটি থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ টিসিএফ গ্যাস তোলা হয়েছে। তারপরও সেখানে প্রায় সমপরিমাণ গ্যাসের মজুদ আছে। ওই গ্যাস তোলার জন্য ওয়েলহেড কম্প্রেসার বসানো প্রয়োজন। সেজন্য এডিবির আর্থিক সহায়তায় বিজিএফসিএল ওই ৫টি কূপে ওয়েলহেড কম্প্রেসার বসানোর প্রকল্প গ্রহণ করে। ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার মধ্যেই ৫টি কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলনের হার দৈনিক ৩০ কোটি ঘনফুট থেকে কমে ২০ কোটি ঘনফুটে দাঁড়ায়। ৫টি কূপে কম্প্রেসার বসানো হলে গ্যাস উত্তোলন আবার ৩০ কোটি ঘনফুটে উন্নীত হবে। এমন অবস্থায় দরপত্র আহ্বান করেও চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে তা বাতিল করতে হয়েছে। দ্বিতীয় দফার দরপত্রেও ওই সিন্ডিকেট সক্রিয়। এবারও যদি কোনো কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয়া না হয় তবে ওসব কূপের ভবিষ্যৎ নিয়েও বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক কাসেম খান জানান, এডিবি চিঠি দিয়ে যে ব্যাখ্যা চেয়েছে তার প্রতিটি প্রশ্নের লিখিত উত্তর দেয়া হয়েছে। এখন এডিবিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত েেনবে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ কী হবে। এই প্রকল্পের দাতা সংস্থা এডিবি, কাজেই তাদেরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা। তবে আগে যে কারণে শর্ট লিস্ট হওয়া কোম্পানি নন-রেসপন্সিভ হয়েছিল, এবার তারা তা পূরণ করেছে। তাছাড়া ওই দরদাতা প্রতিষ্ঠান যে কোম্পানির কম্প্রেসার দিচ্ছে তা বিশ্বসেরা। ওয়াটার কুলিং সিস্টেম অনেক পুরনো। অপরদিকে এয়ার কুলিং আধুনিক ও আপগ্রেড। তাদের এই অভিযোগ সঠিক নয়। তাছাড়া সর্বনি¤œ দরদাতা এপিআই-৬১৮ স্ট্যান্ডার্ডের মান অনুযায়ী দরপত্র জমা দিয়েছে। ওসব অভিযোগের সব উত্তর এডিবিকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।