রাজশাহী মহানগরীতে ক্রমেই বাড়ছে বহুতল ভবনের সংখ্যা। কিন্তু এসব ভবন নির্মানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। আর অনুমোদনের ক্ষেত্রে এসব ভবন মালিকদের সাথে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজস থাকারও রয়েছে অভিযোগ। যে কারণেই এসব ভবন মালিকদের মনোভাব হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। তাদের কাছে নিয়মনীতির উপেক্ষাটা যেন কোন ব্যাপারই নয়। ফলে অপরিকল্পিতভাবেই নির্মিত হচ্ছে বেশিরভাগ বহুতল ভবন। এতে করে ঝুঁকি বাড়ছে। এসব ভবনে থাকছেনা পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপনের ব্যবস্থা। আর রাজশাহীতে বহুতল ভবনে অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থায় ফায়ার সার্ভিসেরও সক্ষমতা নাই বলে অভিযোগ রয়েছে।
মাত্র কয়েক বছর আগেও রাজশাহী মহানগরীতে একতালা থেকে তিনতালা বাড়ি বেশি দেখা যেতো। আর বহুতল ভবন বলতে ছিলো মহানগরীর সিএন্ডবির মোড়ের একটি মাত্র ১০ তালা বিশিষ্ট সুউচ্চ ভবন। যে ভবনটি দেখতে রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও আশেপাশের জেলা থেকে লোকজন আসতো। কিন্তু বর্তমানে বহুতল ভবন নির্মানের প্রতিযোগিতার ভীড়ে এই ১০তলা ভবনের ইমেজ রাজশাহী মহানগরীতে পূর্বের তিন তালা ভবনের ন্যয়ে রুপান্তরিত হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা বহুতল ভবনের অনুমোদন দিচ্ছেন। একইভাবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স রাজশাহী কর্মকর্তারা অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থা না থাকলেও অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থা ভলো বলে অনুমোদন দিচ্ছে।
এ বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে গণপূর্ত দফতরের কয়েকজন কর্মকর্তা মঙ্গলবার (২০ অক্টোবর) দুপুরে প্রতিবেদককে জানান, রাজশাহী মহানগরীতে গত কয়েক বছরের ব্যবধানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বহুতল ভবন। আরডিএ থেকে ৫ তলা পর্যন্ত অনুমোদন নিয়ে নগরীতে ৮০ ভাগের বেশি বহুতল (১০-১২ তলা) গড়ে তোলা হয়েছে। আর এসব ভবনের বিষয়ে আরডিএ কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করছে না। আর অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা নিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছেনা ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষও। শর্ত অনুযায়ী অগ্নিনির্বাপনের যে ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভবন নির্মাণের সময় সেসব শর্ত না মানলেও ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহী মহানগরীতে মূলত ২০০৯ সাল থেকে বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এর আগে নগরীতে ১০ তলা ভবন বলতে ছিল কেবল সিঅ্যান্ডবি মোড়ে জীবন বীমার ভবনটি। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ১০ তলা ভবনের সংখ্যা প্রায় শতের কোটায় ছুঁই ছুঁই করছে। শুধু নগর ভবন থেকে শুরু করে আশপাশে আরও চারটি এবং সাহেববাজার এলাকায় ১০টি, আলুপট্টির মোড়, লক্ষ্মীপুর মোড়, সাগরপাড়া, উপশহর, বর্ণালীর মোড়, আমবাগান, তেরোখাদিয়া, সিপাইপাড়া, হোসেনিগঞ্জ, শেখপাড়া, কাজীহাটা ও পদ্মা আবাসিক এলাকায় রয়েছে প্রায় ৫০টিরও অধিক। আর এসব এলাকাতেই এখন গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন। বহুতল ভবনের তালিকায় এখন পর্যন্ত রাজশাহী মহানগরীতে ১৮ তালা পর্যন্ত রয়েছে। যে কোন মুহূর্তে এটিও পেছনে পড়ে যাবে। সূত্র মতে, একটি গ্রুপ কোম্পানীর তিনটি ২১ তালা বিশিষ্ট ভবন নির্মিত হতে যাচ্ছে। আর মহানগরীতে ১০ তলার নিচে এবং পাঁচ তলার ঊর্ধ্বে ভবনের সংখ্যা রয়েছে কয়েকশ।
মহানগরীতে ভবন নির্মাণের জন্য অনুমোদনকারী প্রতিষ্ঠান রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ)। এই আরডিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে নগরীতে ৬০০ ভবনের অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে পাঁচ তলা পর্যন্ত ৫৬৫টি এবং ছয়ের অধিক তলা ভবনের অনুমোদন ছিল ৩৫টির। ২০১৪ সালে অনুমোদন দেওয়া হয় ৫০২টির। এর মধ্যে ৪৮৬টি পাঁচতলা পর্যন্ত এবং ছয়ের অধিক তলার ভবন ৩৫টি।
২০১৫ সাল থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৩৫৪টি ভবনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩৬টি পাঁচ তলা পর্যন্ত এবং ছয়ের অধিক তলার ভবন অনুমোদন ছিল ৩৩টি। এর পরের ৪ বছরে আরও অন্তত দেড় হাজার ভবনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি ভবনের নকশা অনুমোদনের জন্য আরডিএর অথরাইজড কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নগর পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দফতরে গুনতে হয় লাখ লাখ টাকা। আর টাকা দিলেই জমির শ্রেণি বদলেও মেলে নকশার অনুমোদন। আবার টাকার বিনিময়েই কখনো কখনো মাস্টারপ্ল্যান লঙ্ঘন করেই ভবনের অনুমোদন দেওয়া হয়।
এছাড়া এসব ভবন নির্মাণে থাকার কথা পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা। শর্ত অনুযায়ী পূরণ করার কথা থাকলেও ভবন নির্মাণের সময় সেসব শর্ত অনেক সময় মানা হয়না। তাছাড়া রাজশাহীতে বহুতল ভবনে আগুন নিভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের নেই গাড়ী। যে লেডার (মই) আছে তা দিয়ে ৪/৫ তালার আগুন নির্বাপন করা সম্ভব। কিন্তু এর বেশি তালাতে আগুন লাগলে তা নির্বাপন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের প্রতি। ফলে ধীরে ধীরে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের নগরী হয়ে উঠছে রাজশাহী।
ভবন অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম করা হয় না দাবি করে আরডিএ’র অথরাইজড কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, নিয়মের মধ্যে থেকেই ভবনের নকশার অনুমোদন দেওয়া হয়। কোথাও কোনো অনিয়ম করা হচ্ছে না। তবে ভবন মালিকরা যে নিয়ম মানেন না সেটা স্বীকার করে নিয়েছেন আরডিএর এ কর্মকর্তা। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান তিনি।
এদিকে সিটি করপোরশেন এলাকায় ভবন নির্মাণে আরডিএর পাশাপাশি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) অনাপত্তিপত্র (এনওসি) নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। শুধু নতুন ভবন নির্মাণই নয়, পুনঃনির্মাণের ক্ষেত্রেও রাসিকের অনুমতি লাগবে। এ ব্যাপারে একটি উপ-আইন তৈরি করতে যাচ্ছে নগর সংস্থা। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের একটি প্রস্তাবনা ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ভবন নির্মাণের পূর্বে আরডিএর পাশপাশি সিটি করপোরেশনের কাছ থেকেও অনাপত্তিপত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। নগরীতে বিগত সময়ে তেমন বহুতল ভবন ছিল না। গত ১০ বছর থেকে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। বহুতল ভবন নির্মাণ করতে হলে আরডিএর নিয়ম মেনেই করতে হবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স রাজশাহী সদর দফতরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক অগ্নিনির্বাপনের সক্ষমতা নাই বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, রাজশাহী টিটিএল, হেমা, স্নোগেল গাড়ী নেই। এসব গাড়ীর জন্য চাহিদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব গাড়ীর জন্য যে প্রশস্ত রাস্তা দরকার বহুতল ভবনের সামনে সেরকম রাস্তা নেই। শুধু মাত্র বর্ণালী এলাকা ও উপশহর এলাকায় এসব গাড়ী ব্যবহার করা যাবে। রাস্তা প্রশস্ত না হলে অন্য কোথাও এ গাড়ী ব্যবহার করা যাবেনা। তবে আগামী বছর এসব গাড়ী রাজশাহীতে আসতে পারে আশা করে বলেন, বহুতল যেসব ভবনে অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা তেমনভাবে নেই সেসব ভবনকে চিহ্নিত করে রিপোর্ট দেয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোন অনিয়ম করার সুযোগ নেই বলেও দাবি করেছেন তিনি।