মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী রেমিট্যান্স প্রবাহ কমবে ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ চলতি বছরের তুলনায় আগামী বছর আরও বিপদে পড়বেন অভিবাসীরা। ২০১৯ সালের সঙ্গে তুলনা করে এই হিসাব করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ব্যাংকটির মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিষয়ক সবশেষ পূর্বাভাসে এই আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।
ওই পূর্বাভাসে বলা হয়েছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে চলতি বছর (২০২০ সাল) রেমিট্যান্স প্রবাহ ৭ শতাংশ কমে ৫০৮ বিলিয়ম ডলারে দাঁড়াবে আর এই প্রবাহ আগামী বছর (২০২১ সাল) আরও দশমিক ৫ শতাংশ কমবে। অর্থাৎ ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী রেমিট্যান্স প্রবাহ সাড়ে ৭ শতাংশ কমে নেমে আসবে ৪৭০ বিলিয়ন ডলারে।
রেমিট্যান্স হ্রাসের মূল কারণগুলির মধ্যে রয়েছে অভিবাসীদের কর্মসংস্থান করা দেশগুলিতে দুর্বল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মক্ষেত্রের স্থবিরতা, তেলের দামের পড়তিভাব ও মার্কিন ডলারের তুলনায় রেমিট্যান্সের উৎস দেশগুলোর মুদ্রার অবচয় অর্থাৎ মুদ্রার দাম কমে যাওয়া।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও মাইগ্রেশন স্টিয়ারিং গ্রুপের চেয়ারম্যান মমতা মুরথি বলেন,
অভিবাসন লেন্সের নিচে ফেলে কোভিড-১৯'র প্রভাব দেখলে দেখা যাবে অনেক বড় মাপের ক্ষতির মুখে পড়েছেন অভিবাসীরা আর এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে তাদের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোতে। রেমিট্যান্স প্রবাহের ধারায় প্রাণশক্তি যোগাতে ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
ওই পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২০ ও ২০২১ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহের এই অবনতি বিশ্বের সমস্ত অঞ্চলকে প্রভাবিত করবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমবে ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ায়। এই দুই বছর এই অঞ্চলে যথাক্রমে ১৬ ও ৮ শতাংশ করে কমবে। এরপর রয়েছে পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। এখানে কমবে যথাক্রমে ১১ ও ৪ শতাংশ, মধ্য প্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় দুই বছরই কমবে ৮ শতাংশ করে। সাব-সাহারান আফ্রিকায় কমবে ৯ ও ৬ শতাংশ করে, দক্ষিণ এশিয়ায় কমবে ৪ ও ১১ শতাংশ এবং লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ২০২০ সালে কমবে ০.২ শতাংশ আর ২০২১ সালে কমবে ৮ শতাংশ।
রেমিট্যান্স প্রবাহ আশঙ্কাজনক হ্রাসের পূর্বাভাস দেয়া হলেও নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য বৈদেশিক অর্থায়নের অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত এই খাতটি ২০২০ সালে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে।
ব্যাংকটির হিসাব, ২০১৯ সালে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে রেমিট্যান্স প্রবাহ হয়েছে ৫৪৮ বিলিয়ন ডলার, যা ওই বছরের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ- এফডিআই'র চেয়ে বেশি। কারণ, ২০১৯ সালে এসব দেশে এফডিআই এসেছে ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার আর বিদেশি সহায়তা এসেছে ১৬৬ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্স ও এফডিআই'র মধ্যকার এই ব্যবধান আরও বাড়বে বলে ধরা হচ্ছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, চাপে পড়া অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমার চেয়েও বেশি পরিমাণে কমবে সরাসরি বিদেশি বিনিযোগ।
বিশ্বের অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন নোম্যাড (knomad) এর প্রধান দিলিপ রাঠা বলেন, এই সংকটকালে অভিবাসীরা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও কর্মী ছাঁটাই আতঙ্কে রয়েছেন।
ভিসা জটিলতার মুখে পড়ার কারণেও অনেক অভিবাসী কর্মসংস্থানে যোগ দিতে না পারায় বেকারত্ব সমস্যাও বেশ শক্ত পর্যায়ে পৌঁছাবে বলেও আশঙ্কার কথা জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
এ প্রসঙ্গে ব্যাংকটি সোশ্যাল প্রোটেকশন অ্যান্ড জবস গ্লোবাল প্র্যাকটিস বিভাগের বৈশ্বিক পরিচালক মিচেল রটকোভস্কি বলেন, যে সব অভিবাসী হাসপাতাল, ল্যাব, কারখানাসহ সামনের সারিতে কাজ করেন; মানবিক দিক বিবেচনা করে হলেও তাদের পাশে আরও আন্তরিকতা নিয়ে দাঁড়ানো উচিত।
তিনি আরও বলেন, অবশ্যই অভিবাসীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়া দেশগুলোকে আরও সহায়ক নীতিতে এগিয়ে আসা দরকার যখন অভিবাসীরা তাদের নিজ দেশ বা মধ্যবর্তী কোন দেশ থেকে তাদের কাজে ফিরতে চান।
নিজ দেশে ফেরত আসা অভিবাসীদের পাশেও দাঁড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। চাকরি খুঁজে দেয়া, ব্যবসা খুলে দেয়ার মাধ্যমে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, না হলে তারা ভারী বোঝায় পরিণত হবে। এমনকি আবাসন সুবিধা দিয়েও তাদের সহায়তা করতে হবে।
রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ নিয়ে বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে প্রতি ২০০ ডলার পাঠাতে খরচ পড়েছে ৬.৮ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ২০১৯ সালের তুলনায় বড় কোন পরিবর্তন আসেনি। যদিও, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা- এসডিজিতে বলা হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে এই খরচ নামানো হবে ৩ শতাংশে।
এই খরচ সবচেয়ে কম হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়, ৫ শতাংশ আর সর্বোচ্চ হয়েছে সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলে ৮. ৫ শতাংশ। অভিবাসীদের অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে ব্যয়বহুল মাধ্যম হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে ব্যাংকিং চ্যানেলকে। ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পাঠাতে গড়ে খরচ পড়েছে ১০.৯ শতাংশ। অথচ ডাক বিভাগের (পোস্ট অফিস) মাধ্যমে পড়েছে ৮.৬ শতাংশ, মানি ট্রান্সফার অরারেটররা নিয়েছে ৫.৮ শতাংশ হারে আর মোবাইল অপারেটরদের মাধ্যমে পাঠাতে খরচ পড়েছে ২.৮ শতাংশ।