বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বিসিক। ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী থাকাকালে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন নামে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু দীর্ঘ ৬৩ বছরেও প্রতিষ্ঠানটি পরিপূর্ণ সফলতা অর্জন করতে পারেনি। মূলত অদক্ষতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনার অভাব এবং দুর্নীতির কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানটির সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়নি। এখনো বিসিকের বরাদ্দ পাওয়া ৪৫ শতাংশ প্লটেই শিল্প গড়ে ওঠেনি। বরং শিল্পের নামে বরাদ্দ নিয়ে ওসব প্লট অন্য কাজ করা হচ্ছে। তাছাড়া বিসিকের আওতায় বরাদ্দ নেয়া বর্তমানে ৪৬০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানই রুগ্ন, যা মোট শিল্প ইউনিটের ৮ শতাংশ। আর ৪৫১টি প্লট এখনো খালি পড়ে রয়েছে। বিসিক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিসিকের মৌলিক কাজই হচ্ছে মানুষের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে শিল্পোদ্যোক্তা সৃষ্টি করা। বিসিকের মোট ৭৬টি শিল্পনগরী রয়েছে। আর শিল্পপ্লট রয়েছে ১০ হাজার ৫৯০টি। তার মধ্যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১০ হাজার ১৩৯টি প্লট। খালি প্লটের সংখ্যা ৪৫১টি। তবে বরাদ্দ প্লটের মধ্যে ৫ হাজার ৮৮৩টি শিল্প ইউনিট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার মধ্যে উৎপাদনে আছে ৪ হাজার ৭৩১টি, নির্মাণাধীন ৬৯২টি এবং রুগ্ন বা বন্ধ শিল্পপ্লট ৪৬০টি। বরাদ্দ দেয়া বিসিক শিল্পপ্লটগুলোতে ৯৪৬টি রফতানিমুখী শিল্প গড়ে উঠলেও বাকি ৪ হাজার ২৫৬টি প্রতিষ্ঠানই প্লট বরাদ্দ নিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেনি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিসিকের শিল্পনগরীতে বিনিয়োগ হয়েছে ২৭ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। আর পণ্য বিক্রির পরিমাণ ৫০ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। তার মধ্যে পণ্য রফতানি ২৪ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা আর সরকারকে রাজস্ব দেয়া হয়েছে ২ হাজার ৩৭ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, বিসিকের মূল লক্ষ্য ছিল শিল্পোদ্যোক্তা চিহ্নিত বা উদ্যোক্তা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত গবেষণা, উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, পুঁজির জোগান ও পণ্য বিপণনে সহায়তা করা। তাছাড়া ক্রেতা-বিক্রেতা সম্মেলন আয়োজন, উদ্যোক্তাদের কর কমানোর বিষয়ে পদক্ষেপ এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে সহায়তা এবং পণ্যের মানোন্নয়নে সহায়তা। সবকিছু মিলিয়ে মূল উদ্দেশ্য হলো কম শিক্ষিত মানুষকে দক্ষ কারিগর হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি। দেশের ৬৪টি জেলায় বিসিক তাদের নিজস্ব কার্যালয় স্থাপন করেছে। সারা দেশে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকা- পরিচালনায় ৪টি বিভাগে ৪টি আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপন করা হয়। বিসিকের দাবি, তারা এখন পর্যন্ত ৫ লাখ ৯০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ৪৯৯ জন কর্মকর্তা এবং ১ হাজার ৯২ জন কর্মচারীসহ মোট জনবল ১ হাজার ৫৯১ জন। এখনো ৮১৯টি শূন্যপদ রয়েছে।
এদিকে বিসিকের প্লট বরাদ্দ পাওয়া কোনো কোনো উদ্যোক্তার মতে, প্রভাবশালীদের চাঁদাবাজির কারণে বিসিক শিল্পপ্লটগুলোতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে শিল্পপ্লট বরাদ্দ পেলেও অনেকের পক্ষেই দীর্ঘদিনেও কারখানা স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। বিসিকের প্লট মূলত ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেয়া হয়। উদ্যোক্তারা চাইলে একবারে প্লটের ইজারার পুরো অর্থ পরিশোধ করতে পারে। আবার অর্ধেক নগদ এবং বাকিটা ৫ বছরে ১০ কিস্তিতেও পরিশোধ করতে পারে। তবে ৯৯ বছরের ইজারা হলেও যে কোনো শর্ত ভঙ্গ করলে বিসিক ওই প্লট বাতিল করতে পারে। তবে যারা বরাদ্দ পায় তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নেয়া হয় না। বর্তমানে ঢাকা বিভাগের আওতাধীন বিসিক শিল্পনগরগুলোয় সবচেয়ে বেশি প্লট অব্যবহৃত পড়ে আছে। শিল্পকারখানা করার মতো প্লট এখানকার শিল্পনগরগুলোয় প্লট মালিকরা খালি ফেলে রেখেছে।
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদদের মতে, বিসিক একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু সময়োপযোগী বাস্তবমুখী পদক্ষেপের কারণে ওই সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়নি। ফলে বিসিক একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তারা বিভিন্ন জায়গায় শিল্পপ্লট করেছে কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। এমনকি বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়নি। আবার কিছু ক্ষেত্রে এমন জায়গায় শিল্পনগরী করা হয়েছে, সেখানে মানুষ যেতে চায় না। কেউ কেউ বরাদ্দ পেলেও শিল্প প্রতিষ্ঠান না গড়ে অন্য কাজ করছে। তাছাড়া অনেক প্লট অবরাদ্দও রয়ে গেছে। ওসব কারণে প্রতিষ্ঠানটির সংস্কারের সময় এসেছে। তবে বিসিক কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিষ্ঠানটি ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু সেবা অনলাইনে দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া কেউ শিল্পের নামে বরাদ্দ নিয়ে প্রতিষ্ঠান না গড়লে প্লট বাতিল করা হবে।
এ প্রসঙ্গে বিসিকের শিল্প উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ বিষয়ক পরিচালক মো. খলিলুর রহমান জানান, যারা শিল্পপ্লট বরাদ্দ নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ ব্যাপারে বিসিকের জেলা কমিটি কাজ করে। আর জেলা প্রশাসকরা ওই কমিটির দায়িত্বে থাকেন।
এ ব্যাপারে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিসিক শিল্পনগরীতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উদ্যোক্তারা কারখানা স্থাপন করতে ব্যর্থ হলে প্লট বরাদ্দ বাতিল করে তা অবশ্যই অন্য উদ্যোক্তাকে দিতে হবে। তাছাড়া শিল্পকারখানা ব্যতীত অন্য কোনো ধরনের স্থাপনা রাখলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।