মানবপাচার রোধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে সরকার। কিন্তু তারপরও মানবপাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে সরকার এবার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তার মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন’ আইনের কঠোর বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি দেশের ৭ বিভাগে ৭টি মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মানবপাচার মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তিরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাছাড়া মানবসম্পদ রফতানির সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু আইনেরও সংশোধন আনা হচ্ছে। সরকারের মানবপাচার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মানবপাচার নিয়ে সরকারের বরাবরই কঠোর অবস্থানে থাকলেও থেমে নেই মানবপাচার। বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলায় পৌনে দুই লাখ মানবপাচার মামলা বিচারাধীন। তার মধ্যে ৫ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে ৩০ হাজার ৭১১টি মামলা। আর গত ৮ বছরে ৬ হাজার মামলায় ৯ হাজার ৬৯২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই সময়ে ৫৪ জনের সাজা হয়েছে। তবে মামলা নিষ্পত্তির হার খুবই কম। মানবপাচারের শিকারে পরিণত হওয়া অনেকেই মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ায়, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের বনে জঙ্গলে থাকার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সম্প্রতি লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশীকে হত্যার ঘটনার পর দেশ-বিদেশে তা পুনরায় আলোচনায় উঠে এসেছে। লিবিয়ায় মানবপাচারের ঘঁনায় ইতিমধ্যে অর্ধশতাধিক দালালকে গ্রেফতার এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পাশাপাশি চলছে তদন্তও। বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলায় মানবপাচারের অভিযোগে দায়ের হওয়া ১ লাখ ৮০ হাজার ৬৭৫টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। কয়েক বছর ধরে পাচারকারীরা ইউরোপে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে মানুষকে লিবিয়ায় নিচ্ছে। সেখানে তারা অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ইউরোপে যেতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকেই মারা যায়। বিগত ২০১২ সালে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনটি হওয়ার পর থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার মামলায় ৯ হাজার ৬৯২ জন গ্রেফতার হয়েছে। আর ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ৫৪ জনের সাজা হয়েছে। গত প্রায় ৮ বছরে দেশে ৫ হাজার ৭১৬টি মানবপাচার মামলা করা হয়েছে। তার মধ্যে ২৪৭টি অর্থাৎ মাত্র ৪ শতাংশ মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বিচারাধীন রয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৪০৭টি মামলা।
সূত্র জানায়, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ থেকে মানবপাচার মামলার নথির তথ্যানুযায়ী এক মামলায় ১১৮ বার তারিখ পড়ার পরও সাক্ষী পাওয়া যায়নি। ক্যান্টনমেন্ট থানার ২০০২ সালের একটি মামলায় সাক্ষী হাজির করার তারিখ পড়েছিল ৫৫ বার। তেজগাঁও থানায় ২০০৫ সালের একটি মামলায় পড়েছিল ৪৭ বার। এমন ধরনের ১৮টি মামলায় বারবার তারিখ পড়ার তথ্য মিলেছে। তাছাড়া একজন ভুক্তভোগী বিগত ২০১১ সালে দেশে ফিরে এসে মামলা করে। ওই মামলা এখনো চলছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনে আছে। অথচ ওই আইনের মামলা জামিনযোগ্য নয়। তাছাড়া আইনে সুযোগ না থাকলেও অনেক সময়ই দু’পক্ষ আপোস করে নিচ্ছে। ফলে মামলা চালানো কঠিন পড়ছে। আইন মতে ৯০ দিনের মধ্যে পুলিশ মানবপাচার মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেবে এবং ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে। কিন্তু দেশে তেমন নজির প্রায় নেই বললেই চলে। আইনটিতে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ- অথবা যাবজ্জীবন কারাবাসের পাশাপাশি মোটা অর্থদ-ও রয়েছে। কিন্তু মামলার বিচারের ধীরগতির কারণে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। মূলত অভিযোগকারীর চেয়ে আসামিপক্ষ অর্থবিত্তে ক্ষমতাশালী হওয়া ও আসামিপক্ষ বেশি তৎপর থাকায় মামলার ওপর প্রভাব ফেলে। তাছাড়া অপরাধটির ভয়াবহতা নিয়ে প্রচার বেশি না থাকার কারণে বাদীপক্ষ আদালতের বাইরে মীমাংসা করতে বাধ্য হয়। কোন অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির না থাকলে তা কোনো পক্ষই খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেয় না। সেজন্য মানবপাচারের মামলাগুলো বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় খুব জরুরি।
এদিকে এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমনে ২০১২ সালে যে আইনটি করা হয়েছে তা চমৎকার একটি আইন। তাতে তদন্ত ও শাস্তিসহ বেশকিছু বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু ওই আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তাছাড়া জাতীয় যে কর্মপরিকল্পনা রয়েছে তাও ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বিগত ৮ বছরেও মানবপাচারের মামলাগুলো বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যায়নি। চলতি বছর ৭টি বিভাগে ট্রাইব্যুনাল চালু করে বিচার করার কথা আছে। মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমনের যে আইনটি রয়েছে তার বাস্তবায়ন করার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই ধরনের উদ্যোগের সফল বাস্তবায়ন করা গেলে মানবপাচার সংক্রান্ত ভয়াবহ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো সম্ভব।