রাজধানী জুড়েই রেললাইন, সড়ক, খাল, বিল, নদী সর্বত্র ফেলা হচ্ছে কঠিন ও তরল বর্জ্য। ফলে বর্জ্যেরে ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে পুরো রাজধানী। আর ওসব বর্জ্যরে বড় অংশই অপচনশীল পলিথিন। ফলে ভরাট হচ্ছে খাল-নদী-জলাশয়। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। বিক্রির উপযোগী না হলে বড় মালামাল ময়লাশ্রমিকরা নিচ্ছেন না। এমন অবস্থায় খালে ফেলা হচ্ছে পুরনো জাজিম, লেপ-তোশক, আসবাবের মতো জিনিসপত্রও। তাতে মৃতপ্রায় রাজধানীর অধিকাংশ খাল। তাছাড়া বিভিন্ন স্কুলের পাশেই বর্জ্যরে ভাগাড় গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি নগরজুড়ে গড়ে ওঠা লাখ লাখ ছোট দোকানের বর্জ্য সরাসরি রাস্তায় বা রাস্তার পাশে ফেলা হচ্ছে। আর তা সর্বত্র বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। নগরীর পরিচ্ছন্নকর্মীরা রাস্তাঘাট ঝাড়– দিতে নামলেও প্রতিদিন তৈরি হওয়া বর্জ্যের অর্ধেকই সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করতে পারছে না। ফলে অধরাই থেকে যাচ্ছে বর্জ্যমুক্ত পরিচ্ছন্ন ও সবুজ রাজধানী। ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাজধানীতে বর্জ্য ফেলার সুব্যবস্থা না থাকা ও সচেতনতার অভাবে শুধু দোকান, রেস্তোরাঁ বা বাসাবাড়ির বর্জ্যই নয়, নগরবাসীর হাত থেকেও প্রতিনিয়ত সড়ক, খাল, নালা-নর্দমায় পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। তাতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকার দুই সিটিতে দৈনিক ৬ থেকে ৭ হাজার টন বর্জ্য তৈরি হয়। তার মধ্যে ৩ হাজার ৭০ টন গৃহস্থালি, ১ হাজার ৯৮৩ টন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এবং ১ হাজার ৫৫৫ টন সড়ক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। ওসব বর্জ্যের বড় একটি অংশই সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করতে পারে না। প্রতিদিন রাস্তায় উৎপাদিত প্রায় ১ হাজার ৫৫ টন বর্জ্য সংগ্রহ করতে দুই সিটি মিনি ডাস্টবিন বসালেও তা কোনো কাজে আসেনি। নাগরিক সচেতনতার অভাব, রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি ও দূষণ রোধে কঠোর আইন না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বিগত ২০১৬ সালে দুই সিটির সড়কগুলোতে প্রায় ১১ হাজার মিনি ডাস্টবিন বসানো হয়। বর্তমানে ওসব ডাস্টবিনের অধিকাংশ উধাও। হাতিঝিল পাড়ের অধিকাংশ বাড়ি ও দোকানের বর্জ্য হাতিরঝিলে ফেলা হচ্ছে। ফলে বর্জ্যরে কারণে ঝিলের কয়েক স্থানে ৩০ ফুট পর্যন্ত চর তৈরি হয়েছে। অথচ ওই সড়কেই রয়েছে ডিএনসিসির বর্জ্য ফেলার এসটিএস (সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন)। জিপিও এবং বায়তুল মোকাররম মার্কেটের মাঝের সড়কটির পুরানা পল্টন প্রান্তে রাস্তার ওপরই রাখা হচ্ছে মার্কেটের সব আবর্জনা। সিটি করপোরেশন রাস্তাটি নিয়মিত পরিষ্কার করলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিকের ব্যাগ, কাগজসহ বিভিন্ন আবর্জনায় সড়কটি পূর্ণ হয়ে যায়। ফুটপাথের দোকানদাররা নিজেদের দোকানের সামনের অংশ পরিষ্কার রাখলেও দোকানের তৈরি বর্জ্য ঝাড়– দিয়ে মূল সড়কে ফেলছে। তাছাড়া হাতের নাগালে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) থাকার পরও কুড়িল বিশ্বরোড রেলক্রসিং এলাকার সব ভ্রাম্যমাণ দোকানের বর্জ্য রেললাইনের পাশে ফেলা হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে ঢাকার দুই সিটির কয়েকটি নতুন ওয়ার্ডে বর্জ্য ফেলার কোনো ব্যবস্থাই নেই। ফলে সব বর্জ্য আশপাশের জলাশয়, নিচু জমি ও সড়কের পাশে ফেলা হচ্ছে। এমনকি নদীতে, খালে ও জলাশয়ে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের গবেষণার তথ্যানুযায়ী, বুড়িগঙ্গা নদীর ২৩৭টি পয়েন্ট দিয়ে, তুরাগের ৮৪টি পয়েন্ট দিয়ে, বালু নদীর ৩২টি পয়েন্ট দিয়ে এবং টঙ্গী খালের ৪৭টি পয়েন্ট দিয়ে নিয়মিত কঠিন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। রাজধানীর ২৬টি খাল বর্জ্যের কারণে মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছে। প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ খিলগাঁও-বাসাবো খালে বাসাবাড়ি, দোকান ও বাজারের বর্জ্য ফেলে খালটিকে নর্দমায় পরিণত করা হয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, সিটি করপোরেশনের ভ্যান অস্থায়ী বাজারের বর্জ্য নিতে আসে না। তাছাড়া পাশে খাল থাকায় অনেক বাসিন্দা ও দোকানদার বর্জ্য ফেলতে টাকা খরচ করতে চায় না। খালে বর্জ্য ফেললে কেউ নিষেধও করে না। যে কারণেই খালটির দুর্দশা বাড়ছে। গত ৭ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরের দক্ষিণ বিশিলে গোদাখালী খাল পরিষ্কার করতে গিয়ে জাজিম, পুরনো সোফা, টেলিভিশনের খোলস, ভাঙা ফ্রিজ, টায়ারসহ অনেক ভারী বর্জ্য পায় উত্তর সিটি করপোরেশন। মীরপুর-আগারগাঁও ৬০ ফুট রাস্তার ৪-৫ জায়গায় ময়লার ভাগাড়। মনিপুর স্কুলের পাশেই ফুটপাথ ও আইল্যান্ডের ওপর বর্জ্য স্তপাকারে পড়ে আছে। একই অবস্থা এই সড়কের পীরেরবাগ এলাকায়। মিরপুর-১০ থেকে মিরপুর-১৪ নম্বর যাওয়ার পথে ন্যাম ভবনের বিপরীত পাশে বর্জ্যরে স্তূপ। পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টের বিপরীতে রাস্তার পাশে বর্জ্য ফেলার নির্ধারিত জায়গা থাকলেও ওই রাস্তায় ৩-৪ স্থানে দিনে-রাতে নিয়মিত বর্জ্য ফেলছে আশপাশের লোকজন। মিরপুর মাজার রোডে একটি এসটিএস থাকলেও কাঁচাবাজার ও আড়তের সব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে মূল সড়কে। আগারগাঁও সমবায় মোড়ে কল্যাণপুর খালটি বর্জ্যে ভরে গেছে। বর্জ্যের ওপর জন্মেছে ঘাস। ওই খালের পাশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন বাজার ও দোকানের বর্জ্য খালে ফেলা হচ্ছে। গাবতলী ব্রিজ থেকে বেড়িবাঁধ সড়কটির পাশে সর্বত্র বর্জ্যের স্তূপ।
এদিকে এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান জানন, বেশি বর্জ্য সংগ্রহের জন্য বেশি আর্থিক সুবিধা দিলে ময়লাশ্রমিকরা নিজ উদ্যোগেই বেশি বর্জ্য সংগ্রহ করবে। কিন্তু তারা খুবই কম মজুরি পায়। সিঙ্গাপুরের রাস্তায় কাগজ বা ময়লা ফেললে বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়। বাংলাদেশিরা সিঙ্গাপুরে গেলে ঠিকই ওই আইন মেনে চলে কিন্তু দেশে মানে না। এজন্য এখানেও জরিমানার ব্যবস্থা করা জরুরি। তার আগে অবশ্যই বর্জ্য ফেলার সুব্যবস্থা করতে হবে। এখানে রাস্তায় বিন বসালে চুরি হয়ে যায়। আশপাশের কাউকে তা দেখভালের দায়িত্ব দিলে এমনটা হতো না। দেখভালের জন্য ওই ব্যক্তির কর মওকুফ করতে পারে সিটি করপোরেশন। রাস্তার দোকানগুলোকে তার আশপাশের এলাকা পরিষ্কার রাখতে বাধ্য করা যায়। ময়লা হলে জরিমানা করা হবে। তাহলে সে নিজেও বর্জ্য ফেলবে না, অন্যকেও ফেলতে দেবে না। প্রচুর প্লাস্টিকের কারণে বর্জ্য কম্পোস্টিং করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। যেজন্য জৈব ও অজৈব বর্জ্যরে জন্য আলাদা পরিবেশবান্ধব ব্যাগের ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবেশ সংরক্ষণে সরকার ভালো দাম দিয়ে প্লাস্টিক বর্জ্য কিনে নিতে পারে। সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারলে বর্জ্যও একটা সম্পদ।
অন্যদিকে এ ব্যাপারে ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর মো. বদরুল আমিন জানান, মানুষ সচেতন না হলে দুই কোটি জনসংখ্যার শহরকে বর্জ্যমুক্ত রাখা কঠিন। এজন্য সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলরদের মাধ্যমে নানা সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। মাইকিং, প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছে। এসবের কোনো কিছুতেই কাজ না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। যত্রতত্র ময়লা ফেললে জরিমানার বিধান আছে। পুলিশ ইচ্ছা করলে সিটি করপোরেশন আইনে মামলা দিতে পারে। এই মুহূর্তে সিটি করপোরেশনের সীমিত জনবল দিয়ে তা দেখা কঠিন। সড়কে লোহার বিন বসালে চুরি হয়ে যায়। সেজন্য বিক্রি অযোগ্য বিন স্থাপনের চিন্তা করা হচ্ছে। সবাই সচেতন হলেই শহরকে পরিষ্কার রাখা সম্ভব।
একই প্রসঙ্গে ডিএনসিসির প্রধান বর্জ্য কর্মকর্তা কমডোর এম সাইদুর রহমান জানান, নিজের জায়গা নিজে নোংরা করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে মেয়র মহোদয় খালগুলো পরিষ্কারে হাত দিয়েছেন। খালে যেসব বর্জ্য মিলছে তা অকল্পনীয়। আমরা সচেতন করার চেষ্টা করছি। প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।