সংকটময় পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সহায়ক ভূমিকা রাখে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত টিসিবি নিজেই বড় সংকটে রয়েছে। বিশ্ববাজার থেকে আমদানি ব্যাহত হলে কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে দেশে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। অনেক সময় ব্যবসায়ীরাও সিন্ডিকেট করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। বাংলাদেশের মতো বিপুল জনগোষ্ঠীর একটি বাজার স্থিতিশীল রাখতে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিসিবির যে সক্ষমতা থাকার কথা তা নেই। প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব গুদামের ধারণক্ষমতা মাত্র ৬ হাজার ৮৪০ টন। ফলে ভাড়া করা গুদামেই টিসিবিকে নিজস্ব গুদামের প্রায় চার গুণ পণ্য রাখতে হয়। তাতে সংস্থাটির গুদাম ভাড়া বাবদ প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। আর অর্থ সংকটে ওই ভাড়া পরিশোধে সংস্থাটিকে হিমশিম খেতে হয়। টিসিবি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য সরবরাহের লক্ষ্য নিয়ে টিসিবি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর সংস্থাটি এদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যর পথিকৃৎ হিসেবে কাজ করেছে। তখন টিসিবির মাধ্যমেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শিল্পের কাঁচামাল পর্যন্ত আমদানি করা হতো। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু হওয়ার পর বেসরকারি খাতের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে টিসিবির কার্যক্রম অনেকটাই সীমিত হয়ে যায়। তবে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হলেও সরকারকে সেক্ষেত্রে বাজার নিয়ন্ত্রণে সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখতে হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মোট চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হলে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে যে ব্যবধান সৃষ্টি হয় তা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। সেক্ষেত্রে কোনো অসাধু চক্র অযৌক্তিকভাবে যেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি বা দাম বাড়াতে না পারে তা দেখাও সরকারের দায়িত্ব। টিসিবি হলো সরকারের ওই ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা যায়।
সূত্র জানায়, টিসিবির ভৌত অবকাঠামোগত বেশকিছু অসুবিধার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যর বাজারে সংস্থাটি প্রতিযোগিতা তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এসবের মধ্যে রয়েছে টিসিবির গুদামের স্বল্পতা। তাছাড়া যেসব গুদাম রয়েছে তাও বর্তমানে জরাজীর্ণ। দীর্ঘদিন সংস্কার না করার ফলে গুদামগুলো নাজুক হয়ে পড়েছে। ওসব গুদাম সে সময় সিমেন্ট, লবণ, ওষুধের মতো পণ্য রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। যে কারণে ওসব গুদাম তেল, চিনি, ডাল ইত্যাদি ভোগ্যপণ্য রাখার জন্য উপযুক্ত নয়। আবার ভাড়া করা গুদামও টিসিবির পণ্য রাখার জন্য উপযুক্ত নয়। ফলে ওসব গুদামে পণ্য মজুদের ফলে তার গুণগত মান নষ্টের পাশাপাশি মজুদ পণ্যও নষ্ট হয়ে যায়।
সূত্র আরো জানায়, বছর পাঁচেক আগে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে টিসিবির প্রাতিষ্ঠানিক ও মজুদ সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়। টিসিবিকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করতে ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ সংশোধন করে সংস্থাটির অনুমোদিত মূলধন ৫ কোটি থেকে ১ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ-সংক্রান্ত বিল সংসদে পাসও হয়। কিন্তু এখনো ওই টাকা ছাড় করেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। ফলে টিসিবিকে পণ্য সংগ্রহে সরকারের গ্যারান্টির ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। তাতে পণ্য সংগ্রহে বিলম্ব হয়। আবার সুদের কারণে ভর্তুকিও বেড়ে যায়। তাছাড়া টিসিবির ক্রয়কৃত মালামাল ভোক্তাসাধারণের কাছে সহজে পৌঁছে দিতে ডিলারদের ওপর নির্ভর করতে হয়। ডিলার সংকটের কারণে টিসিবির পক্ষে আরো বেশি ক্রেতার কাছে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় বাজার ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে টিসিবি। আবার বাজারে চাহিদা না থাকায় টিসিবির মজুদ পণ্যের পরিমাণও বাড়ছে। আবার একইভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় যেসব পণ্যর চাহিদা রয়েছে, সেসব পণ্য টিসিবির পণ্য তালিকায় নেই। যে কারণে টিসিবি বাজারে পণ্য সরবরাহ করলেও বাজার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারছে না। টিসিবির পণ্যের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণে জটিলতার কারণেও ভোক্তাস্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এদিকে টিসিবি সংশ্লিষ্টদের মতে, নিজস্ব ভবনের ভাড়া থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়েই টিসিবিকে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হয়। বর্তমানে টিসিবির নিজস্ব আয়ের একমাত্র উৎস প্রধান কার্যালয়ের ভবন ভাড়া। ওই ভাড়ার অর্থ দিয়েই বর্তমান কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ ৩২৫ জনের পেনশন পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হয়। অথচ অনুমোদিত মূলধনের অর্থ বরাদ্দ চেয়ে টিসিবির পক্ষ থেকে কয়েক দফা অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। একপর্যায়ে কিস্তিতে হলেও ওই অর্থ প্রদানের অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু তাতেও কোনো সাড়া মেলেনি। বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, টিসিবির বর্তমান কার্যক্রম বহুলাংশে বৃদ্ধি পাওয়ায় এর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন। সেজন্য সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জমি কেনা বা অধিগ্রহণ, নিজস্ব গুদাম নির্মাণ ও জনবল বৃদ্ধি করা জরুরি। তাছাড়া অনুমোদিত মূলধনের অর্থ টিসিবিকে দেয়া হলে একদিকে যেমন সরকারের ভর্তুকি বহুলাংশে কমবে, অন্যদিকে জনবল বৃদ্ধি এবং বেতন-ভাতা ও পেনশন টিসিবির নিজস্ব আয় থেকে নির্বাহ করা সম্ভব হবে।
অন্যদিকে জাতীয় সংসদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সম্প্রতি টিসিবি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকের আলোচনা সম্পর্কে সংসদীয় কমিটির সভাপতি তোফায়েল আহমেদ জানান, নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগেভাগে চাহিদা নির্ধারণ করে পণ্য মজুদ রাখার পরামর্শ দিয়েছে সংসদীয় কমিটি। সেক্ষেত্রে কোন পণ্যের চাহিদা কত তা অন্তত পাঁচ-ছয় মাস আগে নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে কমিটি আমদানির উদ্যোগ নেয়ার কথা বলেছে। কারণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জোরজবরদস্তি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, টাকা কোনো সমস্যা না। টিসিবিকে কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। আর তাতে যখন যে রকম প্রয়োজন সে রকম করে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়া হবে। সরকার টিসিবিকে আরো বেশি কার্যকর করতে চায়। আরো বড় আকারে টিসিবির কার্যক্রম বিস্তৃত করতে চায়, যাতে আরো বেশি ক্রেতার কাছে পৌঁছা যায়। সেজন্য যেসব উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন সেসব উদ্যোগ নেয়ার সদিচ্ছা সরকারের তা রয়েছে।