মা ইলিশ রক্ষায় নিষেধাজ্ঞার ২২ দিন পর বড় আশা নিয়ে মেঘনা নদীতে নেমেছিলেন লক্ষ্মীপুরের জেলেরা। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর জালে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ার কথা।কিন্তু জেলেদের আশায় গুড়েবালি। প্রত্যাশিত ইলিশ না পাওয়ায় হতাশ জেলেরা।মাছঘাটগুলোতে ইলিশের আমদানি অপ্রত্যাশিতভাবে কম থাকায় অনেকটা অলস সময় কাটাচ্ছেন আড়তদাররাও।
জেলার মজুচৌধুরীর হাটসহ মেঘনার রামগতি উপজেলার গজারিয়া, বয়ারচর, চর আব্দুল¬াহ্,তেলিরচর, আলেকজান্ডার, রায়পুর উপজেলার জালিয়ার চর,পানিরঘাট নদী এলাকায় ভরা মৌসুমে ইলিশের আকাল চলছে।
জেলেদের আশঙ্কা, মেঘনা নদীর নাব্য কমে যাওয়ায় আশানুরূপ ইলিশ মিলছে না। আর জেলা মৎস্য বিভাগ বলছে, জেলেদের এখনই হতাশ হওয়ার কারণ নেই, শীত একটু নামলেই জালে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়বে। বিশেষজ্ঞদের কথা, এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে নদীতে মাছ সংকট আরও তীব্র হবে। মাছ শূন্য হবে মেঘনা।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় প্রায় ৫২ হাজার জেলে রয়েছে। মেঘনা নদীর ওপর নির্ভরশীল ৪৩ হাজার ৪৭২ জন জেলে সরকারিভাবে নিবন্ধিত। ইলিশ রক্ষায় ১৪ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন সাগর-নদীতে মাছ ধরা বন্ধ ছিল। এবার ৬০ ভাগ মা ইলিশ নদীতে ডিম ছাড়তে পেরেছে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এবার ২৫ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। এর বাজার মূল্য প্রায় এক হাজার ২৫০ কোটি টাকা। জেলে ইব্রাহিম জানান, নিষেধাজ্ঞা শেষ ২২ দিন পর মাছ ধরার জাল, নৌকা ও ট্রলার মেরামত করে নদীতে নেমেছেন। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নদীতে জাল ফেলেছেন। কিন্তু সন্ধ্যার আগে যখন বাড়ি ফিরছিলেন, তখন তার মাছের ডালা খালিই ছিল। এখন তিনি ধার ও দাদনের টাকা শোধের চিন্তায় আছেন। নদীতে মাছ ধরা না পড়লে আগামী দিনগুলোতে কীভাবে সংসার চালাবেন ভেবে তিনি অস্থির।
কমলনগর লুদুয়া এলাকার জেলে মো. হোসেন ও মো.আলী, সালাউদ্দিন জানান, তারা সরকারি খাদ্য সহায়তা পাননি। তালিকায় প্রকৃত জেলেদের নাম নেই। জনপ্রতিনিধিরা তাদের পছন্দের লোকদের তালিকায় অন্তুর্ভুক্ত করে ২০ কেজির পরিবর্তে ১৪-১৫ কেজি চাল দিচ্ছেন।
কথা হয় হয় কমলনগর উপজেলার ৫৫ বছর বয়সী জেলে গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে। হতাশার ছাপ স্পষ্ট তার চোখেমুখে। তিনি জানান, এখন দিন-রাত নদীতে জাল ফেলে ইঞ্জিনচালিত নৌকার তেলের খরচও উঠছে না। তা ছাড়া নদীতে ইলিশ মাছ নেই বললেই চলে।
লুদুয়া মাছঘাটের আড়তদার মো.আক্তার হোসেন জানান, মাছঘাটগুলোতে ইলিশের আমদানি না থাকায় অলস সময় কাটাচ্ছেন তারা। নিষেধাজ্ঞার সময় কর্মহীন জেলেদের আর্থিক ঋণ দিয়েছেন তারা। মাছ পেলে সেসব ঋণ পরিশোধ করার কথা ছিল। এখন নদীতে মাছ নেই। ঋণ ফিরে পাওয়া দূরের কথা, এখন আবার জেলেদের সংসার বাঁচাতে তাদের টাকা দিতে হবে।
মতিরহাট মাছঘাটের আড়তদার ও জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি আব্দুল খালেক মেম্বার জানান, এতদিন আশায় ছিলেন অভিযানের পর নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়বে। কেনাবেচায় সরগরম হয়ে উঠবে মাছের ঘাটগুলো। এবারের চিত্র উল্টো। নদীতে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ।
মা ইলিশ রক্ষায় নিষেধাজ্ঞার ২২ দিনে জেলেদের জন্য ২০ কেজি খাদ্য সহায়তা পর্যাপ্ত নয় দাবি করে কমলনগরের চর ফলকন ইউপি চেয়ারম্যান মো. হারুনুর রশিদ বলেন, 'আমার ইউনিয়নে নিবন্ধনকৃত জেলে রয়েছেন ১ হাজার ২৬০ জন। এদের মধ্যে কার্যধারী জেলের সংখ্যা ৮৫৪ জন। তাদের প্রত্যেকের মাঝে চাল বণ্টন করে দেওয়া হয়। ২২ দিনে ২০ কেজি চাল একজন জেলে পরিবারের জন্য একেবারে নগণ্য। চালের পরিমাণ বাড়ানো এবং নগদ অর্থ সহায়তা করার জন্য আমি উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন মিটিংয়ে কথা বলেছি।' তিনি জানান, কার্ডধারী ও নিবন্ধিত জেলেদের মাইকিং করে ডেকে এনে ২০ কেজি হারে যে চাল দিয়েছেন। চালের পরিমাণ বাড়িয়ে নগদ ৪-৫ হাজার টাকা সহায়তা দিলে নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেরা উপকৃত হতেন। তা না হলে জেলেরা ধার-দেনায় ডুবে থাকবেন।
লক্ষ্মীপুর সদর সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. সারোয়ার জামান জানান, মা মাছ ডিম ছেড়েই চলে গেছে সাগরে। এ কারণে নদীতে ইলিশ মিলছে না। এবার ৬০ ভাগ মা ইলিশ নদীতে ডিম ছাড়তে পেরেছে। তবে শীত এলেই জেলেদের জালে প্রচুর পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়বে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মো. বিল¬াল হোসেন বলেন, 'এবার মা ইলিশ রক্ষায় কঠোর অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এ সময় নদীতে জেলেদের তেমন একটা দেখা যায়নি। রায়পুর থেকে রামগতির ট্যাংকি পর্যন্ত নদীর উপকূলীয় এলাকার মাছঘাট এবং জেলে পল¬ীগুলোতে পাহারাদার নিয়োগ করা হয়েছিল। নিষেধাজ্ঞাকালীন মাছ শিকারে বিরত রাখতে নদী ও মাছঘাটে নজরদারি বাড়িয়েছিল মৎস্য বিভাগসহ স্থানীয় প্রশাসন।