আদালতে বিপুলসংখ্যক জঙ্গি মামলা বছরের পর বছর ঝুলে রয়েছে। এ সুযোগে সারাদেশে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের বড় অংশই জামিন নিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জামিন নিয়ে পলাতক থাকা জঙ্গিদের কোনো হদিস পাচ্ছে না। আদালতে বছরের পর বছর প্রায় ৮শ’ জঙ্গি মামলা ঝুলে রয়েছে। তার মধ্যে আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৫৫০টি। আর মন্থর গতিতে ২৫০টি মামলার তদন্ত কাজ চলছে। ওসব মামলায় প্রায় ৪ হাজার জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে জামিন নিয়ে পলাতক আছে দুই শতাধিক। তাছাড়া আরো ৩শ’ আসামি জামিন নিলেও তারা আদালতে হাজির হচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ পর্যন্ত পৌনে ৩ বছরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়া ৭৭৯ জন জঙ্গির মধ্যে ৫৬৪ জন জামিনে বেরিয়ে গেছে। মূলত সারাদেশে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গীর মধ্যে ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ জঙ্গী জামিন নিয়ে বের হয়ে গেছে। আর কারাগারে রয়েছে মাত্র ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ জঙ্গি। তাছাড়া জামিন পাওয়া কমপক্ষে দুই শতাধিক জঙ্গীর কোন হদিসই পাচ্ছে না আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এমন পরিস্থিতিতে জঙ্গিদের জামিন পাওয়া নিয়ে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে চিহ্নিত জঙ্গিদের অকালীন জামিন পাওয়া বন্ধ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে উদ্যোগ নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। একই সাথে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এ ব্যাপারে এখনই প্রশাসনিক বা আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। মূলত তদন্তে গাফিলতি ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা মনে করছেন। জঙ্গি মামলার আসামিদের যথাসময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না হলে জঙ্গি হামলার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে বলেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সূত্র জানায়, প্রচলিত আইনে জঙ্গিবাদের ঝুঁকির বিষয়টি সেভাবে কভার করে না। অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ বিষয়ে আইন সংশোধন করা জরুরি। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষ আদালতের মাধ্যমে ওসব মামলা নিষ্পত্তি করা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকেও সরকারের কাছে আবেদন জানানো প্রয়োজন, যাতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ওসব মামলার বিচার সম্পন্ন করা হয়। জঙ্গি হিসেবে গ্রেফতার হলেও অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে মামলা দায়ের করা হয়। ফলে এভাবে একজন জঙ্গিকে বেশিদিন আটকে রাখা যায় না। তাছাড়া অনেক সময়ই জঙ্গি মামলার সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা সম্ভব হয় না। এমন অবস্থায় সাক্ষী হাজিরের জন্য আদালত থেকে অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানাও পাঠানো হচ্ছে। তবুও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আদালতে সাক্ষী উপস্থিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সেজন্যই জঙ্গি সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন অত্যন্ত জরুরি। আর যেসব জঙ্গি জামিন নিয়ে পলাতক, সেসব মামলায় তাদের জামিনদারদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রয়োজন। জামিনদার সিভিল হোক বা আইনজীবী হোক- জামিন নিয়ে আসামি পলাতক হলে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। কারণ জামিনদারের জবাবদিহিতার নজির সৃষ্টি না হলে জঙ্গিদের জামিন নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা থামবে না।
সূত্র আরো জানায়, জঙ্গিরা জামিন নিয়ে পলাতক হলেও আসামির জামিনদারদের যথাযথ কার্যকর জবাবদিহিতা নেই। এ যাবতকালের মধ্যে জামিনদারদের কারোর বিরুদ্ধেই কোন ধরনের আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জঙ্গিরা নির্বিঘেœ জামিন নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। পলাতকদের মধ্যে অন্তত দু’ডজন ভয়ঙ্কর জঙ্গি রয়েছে, যারা সমরাস্ত্র পরিচালনাসহ শক্তিশালী বিস্ফোরক তৈরিতে পারদর্শী। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে জঙ্গি সংগঠনের উত্থানের নেপথ্যে ওসব দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা কলকাঠি নাড়ছে। আবার কেউ কেউ কারাগারে থেকেও জঙ্গি তৎপরতা চালানোর চেষ্টা করছে। এমন অবস্থায় দেশের বিভিন্ন স্থানে চিরুনি অভিযান চালিয়ে জামিনে পলাতক জঙ্গিদের অবস্থান চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। জামিনে মুক্ত ওসব জঙ্গি সন্ত্রাসী কোথায় আছে সে ব্যাপারে কোন তথ্য পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছে নেই। ওসব পলাতক জঙ্গিকে দ্রুত গ্রেফতার করা না গেলে দেশে নিরাপত্তা হুমকির আশঙ্কা থেকেই যাবে।
এদিকে এ বিষয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইফনিট সংশ্লিষ্টদের মতে, জঙ্গি দমন ও এ সংক্রান্ত মামলা তদন্তে পুলিশের আন্তরিকতার অভাব নেই। প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে সময় লাগায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে চার্জশীট দিতে দেরি হয়। তবে খুব বেশি দেরি করার সুযোগ নেই। কারণ প্রত্যেক মামলার তদন্তে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ওই সময়সীমার মধ্যে অনেক সময় পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা যায় না। আবার যথাযথ তথ্য-প্রমাণ ছাড়া চার্জশীট দাখিল করলে আসামির ছাড়া পেয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ত্রুটিহীন চার্জশীট দিতে সময় বেশি লাগলে আবার জবাবদিহিতার আওতা দিয়ে যেতে হয়।
অন্যদিকে পলাতক জঙ্গিদের বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থা সংশ্লিষ্টরা জানান, জামিন নিয়ে যেসব জঙ্গি পালিয়ে গেছে গোয়েন্দা সংস্থা তার অন্তত দুই শতাধিক জঙ্গির তালিকা তৈরি করেছে। যারা পালিয়ে গেছে তাদের মধ্যে আছে সিরিয়ায় উগ্রপন্থী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নেতা ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন রহমান ইবনে হামদান। বিগত ২০১৪ সালে ঢাকায় মুজাহিদ সংগ্রহে এসে সে গ্রেফতার হয়। কিন্তু জামিনে ছাড়া পেয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে জামিন নিয়ে পলাতক দুর্ধর্ষ জঙ্গিরাও আত্মগোপনে চলে গেছে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ র্যাবের মহাপরিচালক থাকাকালে গণমাধ্যমে বলেছিলেন, গুলশান হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার পর র্যাবের হাতে গ্রেফতার ৫১২ সন্দেহভাজন জঙ্গির ৩শ জনই জামিন পেয়েছে। যার অর্ধেকই এখন পলাতক। জঙ্গি সন্দেহে গ্রেফতার হওয়ার পর জামিনে থাকলে তাদের ওপর ততোটা নজরদারি করা সম্ভব হয় না।