দেশে আশানুরূপভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। বিগত ২০০৮ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালায় ঘোষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত থেকে গত এক দশকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ আসার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই পরিকল্পনার এক-তৃতীয়াংশও অর্জিত হয়নি। এখনো ৪ শতাংশেরও নিচে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পাওয়া বিদ্যুতের পরিমাণ। মূলত সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, দক্ষ জনবল ও প্রযুক্তির অনভিজ্ঞতা এবং সৌরশক্তি ব্যবহারে প্রয়োজনীয় জমির সংকটের কারণেই নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পিছিয়ে রাখছে। সাসটেইনেবল রিনিউয়েবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (স্রেডা) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জীবাশ্ম জ্বালানি প্রযুক্তির ওপর ভর করেই দেশের বিদ্যুৎ খাতে গত এক দশকে অভাবনীয় সফলতা এসেছে। বর্তমানে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৩ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতেরও অন্যসব জ্বালানির মতোই সমান গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশ এখনো সন্তোষজনক কোনো অবস্থান অর্জন করতে পারেনি।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে মোটে ৬৫০ দশমিক ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। যা দেশে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের মাত্র ২-৩ শতাংশ। তার মধ্যে শুধুমাত্র সৌরশক্তি থেকেই উৎপাদন হচ্ছে ৪১৬ দশমিক ২২ শতাংশ বা মোট নবায়নযোগ্য জ্বালানির ৬৪ শতাংশ। তাছাড়া বায়ু থেকে আসছে ২ দশমিক ৯ শতাংশ, হাইড্রো থেকে ২৩০ মেগাওয়াট, বায়োগ্যাস থেকে দশমিক ৬৩ শতাংশ ও বায়োম্যাস থেকে দশমিক ৪ শতাংশ। তবে ইতিমধ্যে প্রকৃতপক্ষে মাত্র ৩১৭ মেগাওয়াটের কাছাকাছি কার্যকরীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। অথচ সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে চলতি বছরের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ২ হাজার ১৮৮ মেগাওয়াটে পৌঁছানোর কথা ছিল।
সূত্র আরো জানায়, দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সৌর, বায়ু ও পানির মতো উৎসকে কাজে লাগিয়ে চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। বিগত ২০১৮ সালে নবায়নযোগ্য বিভিন্ন উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সংক্রান্ত একটি বছরভিত্তিক পরিকল্পনা করা হয়। ওই পরিকল্পনায় ২০১৮ সালকে ভিত্তি বছর ধরে পরবর্তী ৩ বছরের (২০২১ পর্যন্ত) সম্ভাব্য অর্জনের একটি হিসাব করা হয়েছিল। ওই অনুযায়ী নানা ধরনের প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়। ২০১৮ সালে নবায়নযোগ্য বিভিন্ন উৎস থেকে মোট ৫৮৪ দশমিক ৭২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হওয়ার কথা ছিল। তারপর ২০১৯ সালে নতুন ৪৩২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট, ২০২০ সালে ৬০৪ দশমিক ৫ ও ২০২১ সালে ৫৫৫ দশমিক ৫ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
এদিকে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এখন পর্যন্ত মোট ৩৬টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। যার বেশির ভাগই ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে গৃহীত হয়েছে। ওসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দেশের ২৫ জেলায় স্থাপিত সোলার পার্ক থেকে মোট ২ হাজার ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসবে। তার মধ্যে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলায় ৭ দশমিক ৪ মেগাওয়াট, পঞ্চগড় সদর উপজেলায় ৮, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় ২০ ও জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার ৩ মেগাওয়াট সক্ষমতার ৪টি সোলার পার্কের কাজ শেষ হয়েছে। তার বাইরে ময়মনসিংহে নির্মিত এখন পর্যন্ত দেশের বৃহত্তম সোলার পার্কও ইতিমধ্যে উৎপাদনে চলে এসেছে। তাছাড়া চলতি বছরেই আরো ৭টি সোলার পার্ক উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। ওসব কেন্দ্র থেকে মোট ২১২ দশমিক ৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা রয়েছে। বেশির ভাগ সোলার পার্ক পিডিবির অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে। তাছাড়া নবনির্মিত ৪টি সোলার পার্ক এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে ওই প্রকল্পগুলো কিছুটা পিছিয়ে গেছে। তবে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে চলেছে। তার মধ্যে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে ৫০ মেগাওয়াট ও ঈশ্বরদীতে ৩৫ মেগাওয়াটের আরো একটি সোলার পার্ক উৎপাদনে এসেছে।
অন্যদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার কারণ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে পিছিয়ে থাকার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত বিষয়টি নিয়ে কাজ করার জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে বেশ সময় লেগে গেছে। গত ৩০ বছর আগে থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে কাজ শুরু হলেও বাংলাদেশে তা ২০০৮-১০ সালের দিকে শুরু হয়েছে। গত ১০ বছরে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ভালো ধারণা ও দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে সময় লেগে গেছে। তাছাড়া এদেশে দীর্ঘদিন বিদ্যুৎ বিভাগ জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর। ফলে অন্যান্য উৎসকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এখনো বেশ কঠিন। তাছাড়া এ প্রযুক্তি থেকে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার হতো, সেগুলো উচ্চমূল্যের ছিল। এখন দাম কমে আসার ফলে বিনিয়োগ হচ্ছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পিছিয়ে থাকার কারণ প্রসঙ্গে স্রেডার চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলাউদ্দিন জানান, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে প্রথমত অনভিজ্ঞতা, তারপর সেটি ব্যবহারোপযোগী করতে কর্মপরিকল্পনায় দেরি হওয়া এবং ওই জ্বালানির জন্য যে পরিমাণ জমি প্রয়োজন তার সংকট- এসব কিছু মিলিয়েই নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ থেকে পিছিয়ে পড়তে হয়েছে। তবে এখন বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। যদিও সোলার সিস্টেম নিয়ে এগুনোর চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু সেটার ক্যাপাসিটি খুবই কম। ৫ লাখ সোলার সিস্টেম থেকে মাত্র ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। তাছাড়া সোলার নিয়ে বড় আকারে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জায়গা সংকটে পড়তে হয়েছে। এতো বড় প্রকল্প করতে ৩৫০ একর জমির প্রয়োজন। যা করা যায়নি। তাছাড়া টেকনোলজি ডেভেলপ করাটাও বড় একটি চ্যালেঞ্জ ছিল।