এদেশে আশ্রিত উদ্বাস্তু রোহিঙ্গারা মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে নানা অপকর্ম চালাচ্ছে। ইতঃপূর্বে দীর্ঘসময় উখিয়া টেকনাফের ৩৪ শিবির এলাকাজুড়ে থ্রি জি, ফোর জি নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ এনজিও এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তদ্বির ও চাপের মুখে ফের ওসব নেটওয়ার্ক চালু করা হয়েছে। ফলে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের হাতে হাতে এখন দেশীয় সিম। আর তা স্থানীয়দের নামে রেজিস্ট্রেশন করা। বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশী সিমযুক্ত মোবাইল ব্যবহার করছে। ফলে দেশের সব তথ্যই বহির্বিশ্বে নিমিষে চলে যাচ্ছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সব ধরনের অপকর্মের বিস্তৃতিও দিন দিন বাড়ছে। রোহিঙ্গারা মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে ইয়াবা পাচার, মানব পাচার, খুন, ডাকাতি, অপহরণ বাণিজ্য থেকে শুরু করে হেন কোন অপকর্ম নেই যা করছে না। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর কোম্পানির নেটওয়ার্ক সীমান্তের ওপারে রাখাইন জেলার মংডু জেলাজুড়ে বিস্তৃত। সেখানকার নাগরিকদের বড় একটি অংশ বাংলাদেশী সিম ব্যবহার করে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত রয়েছে। সীমান্তের টেকনাফ উখিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত দেশীয় মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার থেকে ওপারের ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। তবে সরকারের গোয়েন্দা রিপোর্টের তথ্যানুযায়ী তার পরিমাণ ১০ কিলোমিটার। ওই নেটওয়ার্ক সুবিধার কারণে মিয়ানমার অভ্যন্তরেও এদেশীয় সিম কার্ড ব্যবহৃত হচ্ছে। যে কারণে সীমান্ত এলাকা থেকে মোবাইল ফোনের টাওয়ার সরিয়ে নেয়ার সুপারিশ করে গোয়েন্দা সংস্থা। তাছাড়া নেটওয়ার্কের ফিকোয়েন্সি কমানোরও সুপারিশ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে সেক্ষেত্রে কোন কাজ হয়নি। এ সুযোগে উখিয়া টেকনাফের নিবন্ধিত ৩৪ ক্যাম্পের প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গার হাতে মোবাইল ফোন রয়েছে। শুধু মোবাইল সিম নয়, রোহিঙ্গারা ক্যাম্পগুলোতে থ্রি ও ফোর জি নেটওয়ার্কে ইন্টারনেট ও স্থানীয়ভাবে ব্রডব্যান্ড লাইনও ব্যবহার করছে। আবার রোহিঙ্গা ভাষায় অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও টিভি নেটওয়ার্কও গড়ে তোলা হয়েছে।
সূত্র জানায়, পুরনো রোহিঙ্গা নেতাসহ স্থানীয় দালালচক্র রোহিঙ্গাদের মোবাইল ফোন ও জাতীয় পরিচয়পত্র বানানোর কাজে জড়িত। একজন নাগরিক ১৫টি করে সিম তোলার অধিকার পাওয়ায় তাদের ওসব সিম নিজেদের নামে রেজিস্ট্রেশন হলেও ব্যবহার করছে অন্য রোহিঙ্গারা। দেশের বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় নাগরিকদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও সিম বিক্রেতারা ১৫টি করে বাংলাদেশী সিম পাওয়ার রেজিস্ট্রেশন কার্ড পূরণ করে নিয়েছে। ১৫টি করে যদি একজন নাগরিক সিম পাবার বা গ্রাহক হয়ে থাকে, তাহলে একজনের পেছনেই ৫টি অপারেটর কোম্পানির ৭৫টি সিম মিলছে। এভাবে মাত্র ১০ হাজার নাগরিকের নামে রেজিস্ট্রেশনকৃত সাড়ে ৭ লাখ সিম রোহিঙ্গাদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। অথচ দেশের মোবাইল কোম্পানিগুলো আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী সিম ব্যবহারের ক্ষেত্রে কড়া কোন উদ্যোগই নিচ্ছে না। ফলে স্থানীয়দের বড় একটি অংশের নাম ঠিকানা ব্যবহার করে রোহিঙ্গারা দেশীয় সিম হাতিয়ে নিচ্ছে। এমনকি দেশের অন্যান্য স্থানের আইডিও ব্যবহার হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে উখিয়া টেকনাফের ৩৪ শিবিরে দেশীয় সিমের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সন্ত্রাসী কর্মকা-ও। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ইয়াবা পাচার।
সূত্র আরো জানায়, আশ্রিত রোহিঙ্গারা কোন ধরনের বাধাবিঘœ ছাড়াই ব্যবহার করছে বাংলাদেশী সিমযুক্ত মোবাইল ফোন। কেউ কেউ আবার মিয়ানমারের সিমও ব্যবহার করছে। অথচ রোহিঙ্গাদের জন্য যে কোন দেশের সিমযুক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারে সরকারের অনুমতি নেই। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নাগরিক। তারা বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হিসেবেই রয়েছে। শরণার্থী আইন অনুসারে কোথাও বা অপর আশ্রয় ক্যাম্পে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে ক্যাম্প ইনচার্জের অনুমতিক্রমে ক্যাম্প প্রশাসনের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগের বিধান রয়েছে। নিজেরা ইচ্ছেমতো আশ্রয়দাতা দেশের বা অন্য কোন সিমযুক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারে না। কিন্তু দেশের বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর কোম্পানির কিছু এসআর এবং ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ও আশপাশে গড়ে ওঠা মোবাইলের দোকানিরা রোহিঙ্গাদের বেশি দামে সিম ও মোবাইল সেট বিক্রি করেই চলেছে। বাংলাদেশী যে কোন সিম হাটেবাজারে ২’শ টাকা হারে বিক্রি করা হয়ে থাকে। তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ওই সিম বিক্রি করা হয় ২ হাজার টাকারও বেশি মূল্যে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের হাতে হাতে স্থানীয়দের নামে রেজিস্ট্রেশনে সিম যাচ্ছে। অথচ রোহিঙ্গাদের বেলায় শরণার্থী আইন ও দেশের প্রচলিত আইন কোনটাই প্রয়োগ করা হচ্ছে না। ফলে রোহিঙ্গারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা ব্যবহার করছে অবৈধ অস্ত্র। সন্ত্রাসী ও মিয়ানমারের বিদ্রোহী সদস্যদের সক্রিয় করে তোলা হচ্ছে। তারা বিক্রি করে চলেছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করছে মিয়ানমারের স্বর্ণের বার। তাছাড়া মোবাইল ফোন যোগাযোগের কারণে ক্যাম্পে প্রায় গোলাগুলি, খুনখারাবি, অস্ত্রের ট্রেনিং, অপহরণ-গুম ও মুক্তিপণ আদায় ইত্যাদি ঘটনা ঘটে চলেছে।
এদিকে মোবাইল অপারেটরগুলো রোহিঙ্গা শিবিরে বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে চালু থাকা প্রায় ৮ লাখ সিম ব্যবহার কোনভাবে বন্ধ করতে চাইছে না। কারণ রোহিঙ্গা শিবির থেকে তাদের দৈনিক আয় প্রায় দেড় কোটি টাকা হচ্ছে। এক পরিসংখ্যান মতে, যদি একজন রোহিঙ্গা দৈনিক মাত্র ২০ টাকার কথা বলে তাহলে ৭ লাখ রোহিঙ্গার কাছে থাকা সিম থেকে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর আয় হচ্ছে প্রতিদিন এক কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর এ কারনেই মোবাইল কোম্পানিগুলো কোটি কোটি টাকার আয় থেকে বঞ্চিত হতে চাইছে না।
অন্যদিকে পুরনো রোহিঙ্গা ক্যাডাররা আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের দোহাই দিয়ে বিদেশ থেকে অঢেল অর্থ এনে সামান্য অংশ রোহিঙ্গাদের বিতরণ করে সিংহভাগ বিদেশী অর্থ আত্মসাৎ করছে। হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশ থেকে অর্থ এনে রোহিঙ্গাদের সামান্য পরিমাণ বিলিবন্টনের ভিডিও ফুটেজ তৈরি করে পুরনো রোহিঙ্গা (আরএসও) নেতারা ৩জি ও ৪জি নেটওয়ার্কের সাহায্যে ক্যাম্প থেকে ওই ভিডিও বিদেশে পাঠাচ্ছে। আশ্রিত রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে গেলে ওই জঙ্গিদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সেজন্য তারা আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সহসা প্রত্যাবাসনে রাজি না হওয়া ও ভাসানচরে না যাবার ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে। অথচ ২০১৯ সালে সরকারের নির্দেশে রোহিঙ্গা শিবিরে থ্রি ও ফোর জি নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখায় রোহিঙ্গারা বেকায়দায় পড়েছিল। কিন্তু পুরনো রোহিঙ্গা নেতা, কিছু এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার তদ্বিরে এ বছরের মাঝামাঝি সময় ফের নেটওয়ার্ক চালু করে দেয়া হয়। নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকাকালীন সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা তাদের অবৈধ কার্যক্রম চালাতে বিভিন্ন শিবিরে মিয়ানমারের সিম এনে ব্যবহার করেছে। ওই সময় র্যাব ও পুলিশ কয়েক দফায় অভিযান চালিয়ে সহ¯্রাধিক মিয়ানমারের সিম জব্দ করেছিল। এ প্রসঙ্গে দেশীয় মোবাইল অপারেটর কোম্পানির এক কর্মকর্তা জানান, মোবাইল কোম্পানিগুলো রোহিঙ্গার নামে সিম বিক্রি করে এমন প্রমাণ নেই।