স্থানীয় দালাল ও জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় মিয়ানমারের সহিংসতায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা ভুয়া পরিচয়ে পাসপোর্ট করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। মূলত তারা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেতে কৌশলে বাংলাদেশি পরিচয়ে পাসপোর্ট পাওয়ার চেষ্টা করছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট করে দিতে শুধু স্থানীয় দালাল চক্র নয়, দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায়ও দালালরা সক্রিয় রয়েছে। ইতিপূর্বে বহুবার কক্সবাজার, নোয়াখালী, বরিশাল, নরসিংদীসহ বিভিন্ন জেলায় রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ বাংলাদেশি পরিচয়ে পাসপোর্ট করতে কর্তৃপক্ষের হাতে এসে ধরা পড়েছে। তাদের আটকের পর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজাও দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও রোহিঙ্গাদের জাল-জালিয়াতি থামনো যাচ্ছে না। বরং টাকা খরচ করলেই তারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেয়ে যাচ্ছে। এ কাজে বাংলাদেশেরই এক শ্রেণীর দালাল চক্র রোহিঙ্গাদের সহায়তা করছে। চট্টগ্রাম বিভাগের একাধিক আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০১৭ সালে কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আড়াইশ’র বেশি রোহিঙ্গার আবেদন শনাক্ত হয়। আর তার অধিকাংশই নারী। তাছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগীয় ও আঞ্চলিক ইমিগ্রেশন এবং পাসপোর্ট অফিসেও রোহিঙ্গা আবেদনকারী ধরা পড়েছে। রোহিঙ্গার হাতে বাংলাদেশি পাসপোর্ট প্রদান ঠেকাতে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতর সফটওয়্যারের সঙ্গে ইন্টারভিউ মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের শনাক্তের কাজ করছে। তারপরও দালালদের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র ও ঠিকানা জাল করে পাসপোর্টের জন্য রোহিঙ্গাদের আবেদন বন্ধ হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে নৃশংসতার শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের অনেকের স্বজনই মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। তাদের কাছে যেতেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। অভিযোগ রয়েছে, একটি দালাল চক্র ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে সম্প্রতি বাংলাদেশি পরিচয়ে পাসপোর্ট করতে এসে ৬ রোহিঙ্গা নারী ধরা পড়লে বিষয়টি জানাজানি হয়। ওই ৬ জনের মধ্যে একজন পালিয়ে যেতে পারলেও বাকি ৫ জনকে আটক করা হয়। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়।
সূত্র আরো জানায়, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র নকল করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও একটি দালাল চক্রের মাধ্যমে বাংলাদেশি পরিচয়ে পাসপোর্ট পেতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে পাসপোর্ট অফিসগুলো এ বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করছে। ফলে ভুয়া আবেদন দ্রুত চিহ্নিত করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট পাওয়া ঠেকাতে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, টেকনাফের হ্নীলা জাদিমুরা এলাকায় গত বছর পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত রোহিঙ্গা নূর মোহাম্মদের সঙ্গে থাকা বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) উদ্ধার করা হয়। ২০১৯ সালের আগস্টে চট্টগ্রামে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী ৩ রোহিঙ্গা যুবক আটক হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের হাতে কীভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট যায় সেসব কাহিনি ও কৌশলের কথা জানা যায়। তারা ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নোয়াখালীর সেনবাগের ঠিকানা ব্যবহার করে এনআইডি সংগ্রহ করে নোয়াখালীর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। ওই সময় জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশকে জানায়, তাদের ন্যাশনাল আইডি কার্ড ও পাসপোর্ট করে দেয়ার জন্য দাদালরা ওই সময় নোয়াখালী নিয়ে কয়েকদিন রেখেছিল। তারা তিন দালালকে ৩টি পাসপোর্টের জন্য যথাক্রমে ১ লাখ ৫ হাজার, ৯০ হাজার ও ৬০ হাজার টাকা দিয়েছে। এভাবে প্রায় সারা দেশেই রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করিয়ে দেয়ার জন্য অনেক দালাল গজিয়ে উঠেছে।
এদিকে এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক আবু সাঈদ জানান, এ অফিসেও কয়েক মাস আগে ৪ জন রোহিঙ্গা পাসপোর্ট করতে গিয়ে ধরা পড়ে। মূলত ইন্টারভিউ করে ওই ৪ রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করে পুলিশে দেয়া হয়েছে। কিছু কৌশলগত প্রশ্ন করলেই তারা ধরা পড়ে যায়। তাছাড়া ভাষাগত কারণেও ধরা পড়ে। কিন্তু এনআইডি বা জন্মনিবন্ধনের কাগজ তারা কীভাবে জোগাড় করেন সেটাই প্রশ্ন। এখন পাসপোর্ট অফিসে এলেই রোহিঙ্গা ধরা পড়ছে। এখন পর্যন্ত পাসপোর্টের আবেদন করতে আসা বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করে পুলিশে দেয়া হয়েছে। তবে তারা আবেদনের আগে এনআইডি, জন্মনিবন্ধন কীভাবে পেল তা জানা যাচ্ছে না। তারা তো পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্টও পায়। সেজন্য ভুয়া আবেদন ধরার জন্য এখন সফটওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি ইন্টারভিউর মাধ্যমেও শনাক্ত করা হচ্ছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও এনআইডির ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদেও বিষয়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ অক্ষুণ রাখতে পাসপোর্ট অধিদফতর জিরো টলারেন্সে রয়েছে। আর ইতিমধ্যে যাদের গ্রেফতার করে মামলা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিটও গঠন হয়েছে।