পিরোজপুরের নাজিরপুরে ফসলি জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি এবং অধিক ফলনের লক্ষ্যে ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো সার) উৎপাদনে বিপ্লব ঘটিয়েছেন বদরুল হায়দার বেপারী নামের এক যুবক। কেঁচো সার মডেল পল্লী গড়ে তুলেছেন এ এলাকায় কৃষকরা। ক্রমাগত রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাড়ায় কমে যাচ্ছে কৃষিজমির উর্বরতা। এর ফলে ফসলের উৎপাদন আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে কৃত্রিম সারের ওপর। তাঁদের দেয়া প্রয়োজনীয় নানা তথ্যের মধ্যে দিন দিন কৃষিজমির উর্বরতা কমে যাওয়ার কথাও জানালেন কৃষকেরা। সরেজমিনে দেখা গেছে, পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলায় বিভিন্ন ফসলের পাশাপাশি বানিজ্যিকভাবে গড়ে উঠেছে নানা ফল-ফলাদির বাগান। বাগান সৃজনের পাশাপাশি ভার্মি কম্পোষ্ট সারের চাহিদাও বেড়ে যাওয়ায় এগিয়ে এসেছেন অনেক কেঁচো সার উৎপাদনকারি। ৮০’ দশকে ইউএনডিপি প্রকল্প এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথভাবে দেশে কেঁচো চাষের সূচনা করে। এরই ধারাবাহকিতায় সার তৈরীতে এগিয়ে এসেছেন ওই উপজেলার অন্তত ২৫ থেকে ৩০ জন সার উৎপাদনকারি।
“প্রকৃতির লাঙ্গল”-নামে পরিচিত কেঁচো জীবন চক্রে খাদ্য খেয়ে যে ‘মল’ ত্যাগ করে এবং ‘চা’ পাতার ন্যায় দেখতে ঝুর ঝুরে হয় সেটাই কেঁচোর জৈব সার। সারাদেশে অধিক ব্যবহৃত এই জৈব সার অন্যতম ও পরিবেশ বান্ধব। প্রধানত; কেঁচো উপরের মাটি নীচে এবং নীচের মাটি উপরে তুলে থাকে। আর এসব কাজের সঙ্গেই প্রাকৃতিকভাবে তৈরী হয় কেঁচো সার। কেঁচো দিয়ে জৈব সার উৎপাদনে প্রথমত; পরিকল্পনামাফিক একটি গর্ত বা গোল বৃত্তের ন্যায় কয়েকটি রিং স্লাব অথবা ছোট আকারের ১৮ থেকে ২০টি পৃথক হাউজ তৈরী করতে হয়। পরে আমদানি করা কেঁচো যেমন: এপিজেকে বা এন্ডোজেসিজ কেঁচো হাউজে ছেড়ে দিয়ে সার উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হয়। কয়েকজন কৃষকের সাথে প্রতিবেদনের জন্য কথা বলতে গিয়ে জানা গেল, ছোটবেলায় বাপ-চাচারা যেভাবে চাষ করতেন এখন সার ব্যবহার ও চাষ পদ্ধতিতে কিছুটা বদলেগেছে। এমনকি ক‘বছর আগেও যতটা সার লাগত, এখন তার চেয়ে বেশি লাগছে। নতুন নতুন রোগের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। আর ফলনও সন্তোষজনক নয়। সব মিলিয়ে তাঁর খরচ বেড়েছে। কেঁচো কম্পোস্ট একটি জৈব সার যা জমির উর্বরতা বাড়াতে ব্যবহার করা হয়। জৈব সার ব্যবহার করেও অধিক ফলন পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন তারা। তাঁদেরই একজন জাগো এগ্রো সলিউশন এর পরিচালক মো. বদরুল হায়দার বেপারী কেঁচো সার তৈরিতে এলাকার একজন সফল চাষি তিনি। নিজের উৎপাদিত কেঁচো সার বিক্রি করে সংসারে এসেছে সফলতা। পিরোজপুর সদর উপজেলার কদমতলা ইউনিয়ন কৃষক আঃ হালিম সরদার সবজি ক্ষেতে কীটনাশক ছিটাচ্ছিলেন। তিনিও জানালেন, আগের চেয়ে কীটনাশক বেশি দিতে হয়। কারণ রোগ বালাই বেড়েছে। দু‘জনই একটি বিষয়ে একমত যে, ভালো ফলনের জন্য আগে যতটা খরচ আর শ্রম দিতে হত, এখন তার চেয়ে বেশি দিতে হয়। অর্থাৎ সমৃদ্ধ ফলনের জন্য জমির প্রাকৃতিক সক্ষমতা কমছে। প্রশ্ন হলো, এর কারণ কী ? এ অবস্থায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন কৃষিজমির উৎকৃষ্ট ব্যবহার। সেক্ষেত্রে জৈব পদ্ধতিতে চাষ সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এই পদ্ধতির সুবিধা হলো, এতে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয় স্বল্প মাত্রায়। কৃষক আবুল সরদার জানান, জৈব সার প্রয়োগ ও জৈব বালাইনাশক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধানসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল ও সবজির উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব। রাসায়নিক সারের চেয়ে খরচ কমায়। মানুষের রোগজ¦ালা ক্রমে বাড়ছে। এর একটা কারণ হলো দৈনন্দিন জীবনে আমরা যেসব খাবার খাচ্ছি, তার চাষে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে। অজান্তেই এসব রাসায়নিক শরীরে ঢুকে যাচ্ছে। তার প্রভাবে কিডনি বিকল হওয়া থেকে শুরু করে ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিও হচ্ছে। এই সমস্যার সহজ সমাধান জৈব পদ্ধতিতে চাষ। জৈব পদ্ধতিতে কেঁচো সারের ব্যবহার বাড়ানো গেলে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব কৃষিব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। এতে চাষের খরচের পাশাপাশি স্বাস্থ্যহানির ঝুঁকিও কমে যাবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ দিগবিজয় হাজরা জানান, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে ভার্মি কম্পোষ্ট উৎপাদনকারিদের মধ্যে সরকারের প্রনোদনার পরিমান আরও বাড়ানো গেলে এ পেশায় আরও নতুন নতুন উদ্যোক্তা যেমন সৃষ্টি হবে, তেমনি রাসায়নিক সারের ওপর কৃষকদের চাপ অনেকাংশে কমে আসবে, এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কৃষিবিদগন। উপ-সহকারি কৃষি বাবুল আকতার বলেন, যেসব কৃষক বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার ব্যবহার করে অধিক উৎপাদনের বিপরীতে ধীরে ধীরে নিজ জমির উর্বরতা-শক্তি হারাচ্ছেন তাদের জন্য ‘কেঁচো-সার’ নিঃসন্দেহে একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে।