নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলা। আর এ উপজেলার কৈমারী ইউনিয়নের সুনগর গ্রাম। এ গ্রামের বাসিন্দা মরহুম নজরুল ইসলামের স্ত্রী মোছাম্মদ খাদিজা আক্তার। ২০১৪ সালের মে মাসে স্বামী মারা যায়। তার মরহুম স্বামী ছিলেন কৈমারী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। জামায়াত অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় তার স্বামীর ওপর চলে অমানবিক নির্যাতন। কৈমারী বাজারে রয়েছে তার একটি কসমেটিক দোকান। স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের মানুষ করতে মা বাজারে ওই কসমেটিক দোকানে নিয়মিত বসতেন। এতেও আসে নানান বিপত্তি। নানা জনে নানান কথা শুনতে হয় তাকে। তারপরও তিনি ভেঙ্গে পড়েননি। স্বামীর রেখে যাওয়া ব্যবসার পুরোপুরি হাল ধরেন তিনি। কঠোর পরিশ্রম ও তীক্ষ বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে ওই ব্যবসা করে তিনি দুই ছেলেকে লেখাপড়া করান। বর্তমানে তার বড় ছেলে খাদেমুল আক্তার জামান স্বজল নর্দান ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ছোট ছেলে সিফাত নাসরাত নয়ন গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ায়ি মাসে প্রথমে তিনি ৮শ চারা দিয়ে ৪৪ শতাংশ জমিতে কফির বাগান শুরু করেন। এ সময় ৮শ চারার মধ্যে ৩২০টি চারা বাগানে মরে যায়। ওই সময় তার আর্থিক ক্ষতি হয় প্রায় ৬৪ হাজার টাকা। তারপরও তিনি হাল ছাড়েননি। এরপর তিনি আবার ৫৮০টি চারা ক্রয় করেন। বর্তমানে তার বাগানে ২৮০টি কফি গাছ রয়েছে। ৬২টি পিলারে রয়েছে ড্রাগন গাছ। এর পাশাপাশি তিনি ২০ শতক জমিতে পেঁপে, ২০ শতক জমিতে ড্রাগন,৪৪ শতক জমিতে কফি, ৩০ শতক জমিতে শরিফা ও ১০ শতক জমিতে রামভুটান চাষ করেছেন। এছাড়াও রয়েছে তার বাগানে মালটা, পেয়ারাসহ ২২ প্রজাতির ফল। তার লক্ষ হলো তিনি ৩ বিঘা জমিতে কফি বাগান করবেন। আর এজন্য তার ব্যয় হবে ৩ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। তিনি বলেন ১ বিঘা জমিতে স্থান পাবে ২৯০টি গাছ। প্রতি গাছে ফল হবে নি¤েœ ৬ কেজি থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত। ১ কেজি ফলের দাম বর্তমান বাজার মুল্য ২ হাজার টাকা। ছোট চারা এক বছর বয়সী একটির দাম ২শ টাকা। বড় চারা দেড় থেকে ২ বছর বয়সী একটির দাম ৩শ টাকা। গাছ রোপনের ২ বছরের মধ্যে ফল আসার কথা কিন্ত্র তার বাগানে ১ বছর ৭ মাসের মাথায় ফল ধরেছে। তিনি বলেন, আমার বড় ছেলে নর্দান ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় ইউটিউবে দেখে আমাকে কফি চাষে উদ্বুদ্ধ করেছে। সে থেকে তার এ কাজে আসা। ছেলে পাশে থাকার কারণে কফি বাজারজাতকরণে অসুবিধা হবে না বলে জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, কফি অন্য যেকোনো ফসলের চেয়ে দাম বেশি। ফলন দেখে বোঝা যায়, এটি অনেক লাভজনক হবে। আমি আগামী বছরে আরও পাঁচ’শ চারা লাগাব। কৃষি বিভাগের লোকজন প্রতিনিয়ত এসে পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে ওই ফল সংগ্রহ কীভাবে হবে, সেটি জানার চেষ্টা করছি। বর্তমানে আমি আর্থিক সমস্যায় রয়েছি। বাগানে ২ জন লোক সর্বক্ষণ কাজ করছে। তাদের মজুরী দেয়া হচ্ছে প্রতিদিন ৬শ টাকা। বাগানের বাউন্ডারী প্রয়োজন। তাছাড়া ৩টি প্রক্রিয়াজাতকরণ মেশিন প্রয়োজন। ওই মেশিন গুলোর দাম প্রায় ১০ লাখ টাকা। স্থানীয় কৃষি ব্যাংকে আমার স্বামীর নোল থাকায় সেখান থেকে আর কোন লোন পাওয়া যায়নি। কৃষি বিভাগ থেকে শুধু মৌখিকভাবে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। সরকারী কোন সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অর্থের অভাবে হয়তো আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে যেতে বসেছে। আমি কৃষি বিভাগসহ সরকারের সহযোগিতা পেলে হয়তো এ বাগানটি টিকিযে রাখতে পারতাম।
এদিকে কৃষি বিভাগের অভিমত, পানি নিষ্কাশনযুক্ত যেকোন উঁচু জমিতে কফি চাষ করা সম্ভব। দেশে বর্তমানে রোবাস্টা ও অ্যারাবিকা, দুই জাতের কফি চাষ হচ্ছে। তবে এ জেলায় রোবাস্টা জাতের কফির ফলন বেশি। তাই বাণিজ্যিকভাবে ওই জাত আবাদের পরিকল্পনা কৃষি বিভাগের। এ ছাড়া কফির ফুল থেকে উন্নত মানের মধু আহরণ করা সম্ভব এবং এ জমিতে মিশ্র ফসল আবাদ করা সম্ভব।
কৈমারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রেজাউল হক বাবু বলেন একজন নারী হয়ে এ কফি চাষ করে তিনি এলাকায় অন্যান্য নারীদের চোখ খুলে দিয়েছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন নারীরাও চাষাবাদ করতে পারে। তার এ ধরনের কাজে সবার সহযোগিতা করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, কফি সাধারণত পাহাড়ি ফসল। উঁচু এবং যেখানে পানি জমে না থাকে, এমন সমতল জমিতে কফি চাষ যাবে। নীলফামারীর মাটি বেলে-দোঁআশ হওয়ায় এ মাটি কফি চাষের উপযোগী।