মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে প্রাণ দিয়েছে শেরপুরের অসংখ্য নারী-পুরুষ। গণহত্যার পর কোথাও মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, কোথাও লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে নদীতে। কিন্তু যুদ্ধদিনের নিরব স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি আজো। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী স্থান, গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো সরকারিভাবে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা।
’৭১-এ বর্বর পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা হামলা চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সহ বহু নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুকে গুলি করে হত্যা করেছে। সারাজেলাতেই এ হত্যাকান্ড চললেও উল্লেখযোগ্য ভাবে জেলার সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ীর সোহাগপুর, তন্দর, নাকুগাঁও এ বিএসএফ সদস্যসহ কয়েক শত মানুষ হত্যাকান্ডের শিকার হন। সব মিলে এ উপজেলায় ৫৯টি গণকবর রয়েছে। এ ছাড়া সদর উপজেলার সূর্যদি গ্রামে ৬২জন, ঝাউগড়া গ্রামে ৮ জন, ঝিনাইগাতীর জগৎপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৪২জন সহ ৫৮ জন, কাঁটাখালি ব্রিজ ও রাঙ্গামাটিয়া খাটুয়াপাড়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা সহ ১২জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
এসব ঘটনার নির্মমতার স্মৃতি চিহ্নগুলো রয়েছে আহাম্মদনগর পাক ক্যাম্প ও নকশী পাক ক্যাম্প, নালিতাবাড়ীর রামচন্দ্রকোড়া ফরেস্ট পাক ক্যাম্প, নকলার নারায়ণখোলা, শ্রীবরদীর কাকিলাকুড়ায়। রয়েছে বীরবিক্রম শাহ মুতাসীন বিল্লাহ খুররমের সমাধিস্থল। শেরপুর শহরের শেরিব্রিজ, সুরেন্দ্র সাহার বাড়ির আলবদরদের টর্চার সেল, সদর থানার সামনে অ্যাডভোকেট এম এ সামাদের বাড়ির বধ্যভূমি, জেলা প্রশাসকের বাংলোর পাশে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির কার্যালয়সহ নানা জায়গা মহান মুক্তিযুদ্ধের নিরব স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
যুদ্ধদিনের স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও স্ত্রী-স্বামী-সন্তান ও ভাই হারানো ব্যথায় কষ্ট পায় স্বজনরা। সরকারিভাবে তাদের স্বজনদের স্মৃতিগুলোকে সংরক্ষন করা হচ্ছেনা এমন অভিযোগ শহীদ পরিবারের সদস্যদের।
সরকারী উদ্যোগে নির্মিত ঝিনাইগাতী কোয়ারীরোড বধ্যভূমিতে গিয়ে দেখা যায়, স্মৃতিস্তম্ভের পাশে বাঁশঝাড়ের নিচে শহীদের গণকবর। কোনো নামফলক নেই। কেউ দেখিয়ে না দিলে আঁচ করাই যাবে না এটি জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি। সীমানাপ্রাচীর না থাকায় স্মৃতিস্তম্ভের বেদিতে খড় শুকানো হচ্ছে ও বেডমিন্টন খেলার জন্য ঝুঁলানো হয়েছে নেট। স্মৃতিস্তম্ভের উপরে গরু দাঁড়িয়ে আছে, পাশেই কয়েকটি গরু ঘাস খাচ্ছে। অযতেœর ফলে স্মৃতিস্তম্ভে শেওলা পড়ে গেছে, জন্মেছে অসংখ্য পরগাছা।
ঝিনাইগাতী উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সরকারী উদ্যোগে ২০০৮ সালে জেলার সবচেয়ে বড় ঝিনাইগাতীর কোয়ারীরোড এলাকার বধ্যভূমির পাশে এলজিইডি’র অর্থায়নে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। আহমদনগর বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ ছাড়া এখানে আর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী শেরপুর জেলায় সবচেয়ে বড় ক্যাম্প স্থাপন করে ঝিনাইগাতীর কোয়ারীরোড এলাকায়। ক্যাম্পের পাশেই ছিল টর্চার সেল। যুদ্ধের সময় মানুষের আর্তচিৎকার এখান থেকে ভেসে আসত। ক্যাম্পের ৫শ মিটার পশ্চিম পাশে ১০ শতাংশ জমিজুড়ে তিন ফুট গর্ত ছিল। যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনী অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে এই ক্যাম্পে নির্যাতন করে হত্যার পর এই গর্তে লাশ ফেলে দিত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রামবাসী এলাকায় ফিরে আসেন। তখন তারা বড় গর্তটিতে অসংখ্য লাশ দেখতে পান। গ্রামবাসী মিলে গর্তে থাকা লাশগুলো মাটিচাপা দেন।
ঝিনাইগাতী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমা-ার বীর মুক্তিযোদ্ধা সুরুজ্জামান আকন্দ বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার এতদিন পর স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচারের মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এই সরকারের আমলে মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতিস্তম্ভটি অযতœ ও অবহেলায় থাকবে, এটি মেনে নেয়া যায় না। আজ পর্যন্ত এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। কৃর্তপক্ষের নজরদারি না থাকায় এখানে অবাধে বিচরণ করে গরু-ছাগল। শুকানো হয় গরুর গোবর। এটি জাতির জন্য খুবই লজ্জা ও দুঃখজনক বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ভবিষৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত করতে হলে এসব বধ্যভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো দ্রুত সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। তাই তিনি সরকারীভাবে এসব গণকবর, বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের দাবী জানান।
হাতীবান্দা ইউপি চেয়ারম্যান মো. নুরুল আমীন বলেন, এই বধ্যভূমির কোনো সীমানাপ্রাচীর নেই। এমনকি দেখাশোনার জন্য কোনো কমিটিও নেই। তিনি নিজ উদ্যোগে মাঝেমধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে থাকেন।
ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবেল মাহমুদ বলেন, এই বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা হয়েছে। দ্রুত একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বধ্যভূমির সীমানাপ্রাচীরসহ সারা বছর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ ছাড়া নতুন প্রজন্ম যেন এই বধ্যভূমির ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে, সে জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।