জগতের সবকিছুই নিয়মের অধীন। নিয়মব্যতীত কোনকিছুই চলে না, আর যা চলে তা প্রাণী নয়, জড়বস্তু। চন্দ্র-সূর্য নিয়ম মেনেই উদিত হয় এবং অস্ত যায়। নিয়মমাফিক দিন ও রাত হয়। সেই নিয়মের ধারাবাহিকতায় শেষ হচ্ছে একটি বছর। আসছে নতুন বছর । নতুন মানেই আনন্দের-উচ্ছাসের। আর পুরাতন অর্থই প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ও যোগ-বিয়োগের। নতুন বছর শিশু শিক্ষার্থীদের কাছে নতুন বই পাওয়ার উৎসব। নতুন বছর তরুন শিক্ষার্থীদের কাছে নতুন ক্লাসে ওঠার প্রয়াস। নতুন বছর শিক্ষকের কাছে নতুন বই পড়ানোর আনন্দ। নতুন বছর চাকরীজীবীদের কাছে পদোন্নতি পাওয়ার আশ্বাস। আর কৃষকের কাছে নতুন বছর নতুন ফসল ও ন্যায্য মজুরী পাওয়ার প্রত্যাশা। সকলের জীবনেই নতুন বছর অর্থই যেন নতুন প্রাপ্তি। সবকিছুই একটি লক্ষ্য আছে। আর লক্ষ্যকে নিয়েই গড়ে ওঠে প্রত্যাশার জায়গা। আমরা যে সবুজ-সোনালী শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশে বাস করি এই অপরূপ দেশের প্রকৃতিরও একটি লক্ষ্য রয়েছে। বাংলাদেশে রয়েছে ছয়টি ঋতু। গ্রীষ্মকাল, বর্ষাকাল, শরৎকাল, হেমন্তকাল, শীতকাল ও বসন্তকাল। প্রত্যেকটি ঋতুরই কিন্তু একটি লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য আছে। যেমন গ্রীষ্মকাল আসলেই আমরা গরম অনুভব করি। প্রকৃতিতে প্রখর সূর্যের তাপে বেড়ে যায় তাপমাত্রার ডিগ্রী। আম-জাম-কাঁঠাল পাকে। গ্রীষ্মের কথা ভাবতেই যেন মনে হয় কোন কোন ফল প্রকৃতিতে পাবো। তারপর আসে বর্ষা। বর্ষা মনে করতেই যেন বৃষ্টির আভাস মনে চলে আসে। চলে আসে কাদা-মাখা শৈশবের স্মৃতি। এভাবেই চলে শরৎ ও হেমন্ত। তারপর শীত মানেই যেন রুক্ষত্বক আর শীতল অনুভ’তি। ছিন্নমূল মানুষের অসহাত্ব জীবন। শিশু ও বৃদ্ধদের কষ্টময় জীবন। তারপরই আসে বসন্ত। বসন্তে মনে আনে সতেজতার ছাপ। গাছে-গাছে নতুন পাতা সবকিছু মিলিয়ে প্রকৃতি সাজে অপরূপ রূপে। তাই বসন্তকে বলা হয় ঋতুরাজ। যে কথাটি পূর্বে বলেছিলাম আর যে কারণে প্রকৃতির ঋতুর বর্ণনা। আসলে আমাদের প্রত্যেক্যের জীবন সময়ে-নিয়মেই বাধা। আমরা কেউ ইচ্ছে করলেই কিন্তু পূর্বের জীবনে ফিরে যেতে পারি না। সেই কারণে প্রত্যেকেরই নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা পরিল্পনা নিয়ে জীবনকে সাজাতে হয়। আর পরিকল্পনাবিহীন জীবন নাবিকবিহীন জাহাজের মত। গল্পে পরেছি নাবিকবিহীন জাহাজ কিন্তু সঠিক গন্তব্যে পৌছায় না বা সঠিকপথে চলে না। ঠিক মানবজীবনও তেমনি। লক্ষ্যটা ঠিক বা নির্দিষ্ট না হলে জীবনে কিন্তু সফলতার মুখ দেখা কঠিন। জাহাজের লাইন থেকে আমরা কিন্তু এমনটাই ইঙ্গিত পাই। জীবনে চলার পথে সকলে যে সফল হয় তা কিন্তু নয়। আবার সকলে যে বিফলে যায় তাও কিন্তু নয়। তবে পরাজয়ের গ্লানি জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। আমরা হয়ত রাজার্ রবার্ট ব্রুশের কাহিনী জানি। তিনি বার বার যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন শত্রপক্ষের দ্বারা। এক পর্যায়ে তিনি আশাহত হয়েছিলেন। এমন সময় তিনি দেওয়ালে একটি মাকড়সাকে দেখলেন বার বার বেয়ে ওঠার প্রচেষ্টা। সাত সাত বার মাকড়সাটি উঠতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু মাকড়সাটি থেকে থাকেনি। অদ্যম মনোবলের কারণে অষ্টমবার মাকড়সাটি দেওয়াল বেয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। মাকড়সার সেই প্রচেষ্টার্ রবার্ট ব্রুশের মনে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। মাকড়সার সেই মনোবল তার মনোবলকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই কারণে শেষ প্রচেষ্টায় রাজা জয়ী হয়েছিলেন। এই যে একটি ছোট্ট প্রাণীর থেকে উৎসাহ তাকে অনেক সফল মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার শিক্ষা দিয়েছিল। সেই কারণে তাঁর কথা আজ আমরা জানছি, পড়ছি। বাস্তবজীবনেও আমাদের শেখার অনেক জায়গা আছে। প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তু বা প্রাণী থেকেই আমরা শিক্ষা নিতে পারি। কিন্তু আমরা সেই শিক্ষা গুলো নিতে পারি না। নিতে চাই না। আমরা যদি একটি জিনিস থেকে শিক্ষা নেই অথবা একটি কিছু ভাল করে করি আমার বিশ্বাস তাতেই আমরা ভাল কিছু উপহার দিতে পারব। কিন্তু আমরা অনেকে আছি লক্ষ্যটা নির্ধারন করতে পারি না। ফলে লক্ষ্যহীনভাবে চলি। পাই না কোন তরী। সত্যই আজ যারা বিভিন্ন সফল ব্যক্তিদের জীবনী পড়েন আমার বিশ্বাস তারা আমার সাথে একমত হবেন যে, তারা কিভাবে এসেছে। তাদের সাফল্যটা কিভাবে এলো। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে আবেদের কথাই ভাবুন। সিলেটের হবিগঞ্জের বানিয়াচং তার গ্রামের বাড়ি। আজ থেকে কয়েক বছর আগে আমি আমার এক বড় ভাইয়ের চাকরিরসূত্রে গিয়েছিলাম বানিয়াচং থানায়। তাও আবার ব্র্যাকেই তার চাকরীর যোগদানের জন্য্। কি গ্রাম ? তখনও জানতাম না এই সাফল্যমন্ডিত মানুষটির বাড়ি এই অঞ্চলে। তিঁনি মারা যাওয়ার সময় যখন শুনলাম তখন অবাক হলাম। কতটা মেধা থাকলে এটা সম্ভব? আজ সারা বাংলাদেশে ব্র্যাকের নামে ভাল ভাল স্থানে জমি রয়েছে। অথচ তার গ্রামের বাড়ি একটি অচিনপুর গ্রামের মত গ্রামে। যেখানে গিয়ে আমি চালকদের কথা বুঝতে পারি নাই। মনে হয়েছিল কোথাই যেন এলাম। এই ফজলে আবেদই সিলেটের বিভিন্ন অনুন্নত এলাকাকে উন্নত এলাকায় পরিণত করেছেন। অর্থনীতির মাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলাকে। আসলে চেষ্টা আর মনোবল থাকলে কি না সম্ভব?? একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে যেতে পারে সাফল্যের চূড়ান্ত চূড়ায়। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বদলে দিতে পারে জীবনের গল্প। একটি প্রচেষ্টা হতে পারে জীবনের সেরা গল্প। হয়ত আপনার সেই গল্প পড়েই অনুপ্রেরণা পাবে আগামীর প্রজন্ম। চলুন সকলে হাতে হাত মিলে লক্ষ্য নির্দিষ্ট করি। নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে নতুন বছর শুরু করি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট