৪৭ বছর একসঙ্গে থাকার পর আজ (৩১ ডিসেম্বর) মধ্যরাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে চূড়ান্তভাবে বের হয়ে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য। এর আগে গত ২৪ ডিসেম্বর ব্রেক্সিট পরবর্তী বাণিজ্য চুক্তিতে এক মতে আসে ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ২৬ ডিসেম্বর প্রকাশ করা হয় ওই চুক্তির বৃত্তান্ত।
১২শ’ পৃষ্ঠার বেশি ওই চুক্তিপত্রে কি আছে?
বাণিজ্য বিষয়ক:
২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এই চুক্তিটি কার্যকর হবে। এর ফলে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে পণ্য বাণিজ্যে কোন শুল্ক বা পণ্য পরিমাণের সীমানা থাকবে না। তবে, নিরাপত্তাজনিত কারণ ও কাস্টমস ছাড়পত্রের জন্য সীমান্ত পারাপারকালে নতুন ধরনের চেকিংয়ের (পরীক্ষা-নিরীক্ষা) দরকার হবে।
যুক্তরাজ্য থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাণিজ খাবার রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন বিধি নিষেধ আরোপ হবে। যেমন, রান্নাছাড়া মাংস, সসেজ বা বার্গার ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সংরক্ষণ করা হলে তা যুক্তরাজ্য থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে ঢুকবে না।
আমদানি-রপ্তানি সহজ করতে বন্দর ছাড়ের জন্য দু’দেশকে এখনও অনেক কাজ করতে হবে।
সার্ভিসেস ও কোয়ালিফিকেশনস:
যুক্তরাজ্য থেকে আগে যেমন ব্যাংকিং, স্থাপত্য ও হিসাব খাতের চাকরিতে ইইউ’তে বাধামুক্ত প্রবেশাধিকার ছিল। এখন আর এধরনের সেবাখাতে যুক্ত হতে আগের মতো সুবিধা পাবে না ব্রিটিশ নাগরিকরা।
চিকিৎসা, স্থাপত্যবিদ্যা, শেফ- এসব বিষয়ে আগে যেমন যুক্তরাজ্য থেকে পাওয়া সনদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাকি দেশগুলো একই মান্ডদণ্ডে গ্রহণ করতো এখন আর তা করা হবে না।
শুধু তাই নয় এই জোটের প্রতিটি দেশের সঙ্গে এসব খাতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে পৃথক পৃথক চুক্তি করতে হবে যুক্তরাজ্যকে। তবে, আশা করা হচ্ছে আগামীতে সেবাখাতের সম্প্রসারণে উদার হবে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
ভ্রমণ:
ইউরোপীয় ইউনিয়ন জোটভুক্ত দেশে ৯০ দিনের বেশি অবস্থানের জন্য এখন থেকে ব্রিটিশ নাগরিকদের ভিসা লাগবে। কোন ‘পেট ভিসা’ থাকবে না। তবে, মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ইউরোপিয়ান স্বাস্থ্য বীমা কার্ডের সুবিধা বহাল থাকবে। যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের জন্য বাড়তি রোমিং চার্জও আরোপ করা হবে না। যদিও জলপথের ভ্রমণকে নিরুৎসাহিত করা হবে।
স্বাস্থ্য বীমা কার্ডের ব্যাপারে যুক্তরাজ্য বলেছে, তার দেশের নাগরিকদের জন্য ‘ইউকে গ্লোবাল হেল্থ ইনস্যুরেন্স কার্ড’ নামে একটি সুবিধা চালু করবে। তবে, এ ব্যাপারে এখনও বিস্তারিত কিছু জানায়নি ব্রিটিশ সরকার।
আর আগের মতো পেট ভিসা না থাকলেও ব্রিটিশরা পোষা প্রাণি নিয়ে যেতে পারবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে। সেক্ষেত্রে প্রতিবার ভ্রমণেই নতুন নতুন করে প্রাণির স্বাস্থ্য সনদসহ নানান সনদ সংগ্রহে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে।
যেহেতু যুক্তরাজ্যের মোবাইল অপারেটর কোম্পানি রোমিং চার্জ করবে, সেক্ষেত্রে বিদেশ ভ্রমণের আগেই এ ব্যাপারে ব্রিটিশদের সচেতন থাকতে হবে।
মৎস্য আহরণ:
ব্রেক্সিট পরবর্তী বাণিজ্য চুক্তির পথে সবচেয়ে আলোচিত ছিল যে ইস্যুটি তা হল মৎস্য আহরণ। বলা হচ্ছিল, মৎস্য শিকারে যুক্তরাজ্য সন্তুষ্ট না হলে হয়তো চুক্তিই হবে না।
এ প্রসঙ্গে চুক্তিতে বলা হয়েছে, আগামী সাড়ে ৫ বছর যুক্তরাজ্য তার জলসীমায় ক্রমাগত বেশি পরিমাণ মাছ শিকারের সুযোগ পাবে। আর ২০২৬ সাল থেকে যুক্তরাজ্য তার জলসীমায় অন্য দেশের মাছ শিকারিদের প্রবেশ ঠেকাতে পারবে। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলসীমায় মাছ শিকার করতে গেলে জোটটিও যুক্তরাজ্যের ওপর কর আরোপ করার সুযোগ পাবে।
২০২৬ সালের পর থেকে মাছ শিকারের সুবিধার ব্যাপারে যুক্তরাজ্য ও ইইউ’কে নিয়মিত বৈঠকে বসতে হবে। এর মানে এই ইস্যুতে আগামীতে আরও কঠিন কঠিন শর্তের মুখে পড়তে যাচ্ছে উভয়পক্ষ।
ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস ও অন্যান্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি:
২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সর্বোচ্চ আদালত ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস’র কোন আইন আর যুক্তরাজ্যের জন্য প্রযোজ্য হবে না। তাই অমীমাংসিত ইস্যুতে নিষ্পত্তিতে বিরোধে জড়ানো দেশের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে কাজ করতে হবে ব্রিটিশ সরকারকে।
তবে, নদার্ন আয়ারল্যান্ডের ওপর ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস’র আইন আরোপিত থাকবে। কারণ, দেশটি এখনও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কিছু বাণিজ্যনীতি অনুসরণ করতে চায়।
বর্তমান চুক্তির আওতায় যদি পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিতে দুই দেশই কিছুটা দূরে যায়, এ ব্যাপারে পরবর্তীতে শক্ত বিধান আরোপের সুযোগ রাখা হয়েছে সুবিধাজনক বাণিজ্য চুক্তিতে।