স্বাধীন দেশের মানুষের অফুরন্ত আশার মাঝে আশ্বাসেরও যেন শেষ নেই। কিন্তু অবস্থা দৃশ্যে মনে হয়, এসব আশ্বাস যেন ভূতের মুখে রাম নামেরই শামিল। বাস্তবে দেশের মানুষের আশা, আকাংখা ও প্রত্যাশা স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। যার মধ্যে রয়েছে শুধু আশ্বাসের গড্ডালিকা প্রবাহ। আর ইত্য সময়ে এক শ্রেণীর লোক শুধু আঙুল ফুলে কলাগাছই হয়নি, বটগাছও হয়ে গেছে। এর পেছনে রয়েছে জবাবদিহীতার অভাব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও দুর্নীতি। যার সীমা পরিসীমা নেই। যেভাবে চলছে এভাবে চললে এক সময় দুর্নীতির অতল গহ্বরে বিলীন হয়ে গেলে বলার কিছু হয়তো আর অবশিষ্ট থাকবে না। দেশে অসংখ্য সংস্থা ও সমস্যা রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে (ক) নির্বাচন কমিশনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (২) দুর্নীতি দমন কমিশনের অপারগতা (গ) নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ (Judicial Separation) (ঘ) আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ আরও অনেক সমস্যা।
দুর্নীতি এখন মহামারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দুর্নীতি দমন ব্যুরো ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে তদানীন্তন পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তেমন ফলপ্রসূ ভূমিকা নিয়ে জনগণের মাঝে আস্থা অর্জন করতে পারে নাই বলে দুর্নীতি প্রতিরোধে তেমন ফলপ্রসূ ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। ২০০৪ সালের ২৯ নভেম্বর দুর্নীতি দমন ব্যুরো থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গঠিত হলে দেশে সাড়া পরে যায়। তারপর দুদক একটু উঠে পড়ে বসলেও যে প্রত্যাশা ও স্বপ্ন ছিল তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। যদিও এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ও দুদক চেয়ারম্যানের অক্লান্ত পরিশ্রমকে খাটো করে দেখা যায় না। ব্যাংক, বীমায় সীমাহীন কেলেংকারি, ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপী, তদোপরি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কোটি কোট টাকা আত্মসাৎ ও অনিয়ম ভুলা যায় না। ফলশ্রুতিতে এসব টাকা আত্মসাৎ করে অনেকেই মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে পাড়ি দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যসহ বেগমপাড়া গড়ে তুলেছে। দুর্নীতিবাজরা নিজেদের রক্ষাকল্পে আগেই আইনজীবী ঠিকঠাক করে রাখে। তাই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো নি¤œ ও উচ্চ আদালতে মামলা হলে তাদের নিয়োজিত আইনজীবীরা কুশীলবদের বাঁচানোর জন্য ওঠে পড়ে লেগে যায়। এছাড়া দুদকের নিয়োজিত আইনজীবীদের হাবভাব দায়সারা বলে মনে হয়ে থাকে। যে কারণে সাবেক দুদক চেয়ারম্যান লেঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মশহুদ চৌধুরী অবসরে যাওয়ার আগে দুদকের এক সেমিনারে বলেছিলেন, I am undone & unable অর্থাৎ আমি অসহায় ও অসমর্থ। এই দুর্নীতি এখন দেশের সব অর্জনকে হাতির পালের মতো লন্ডভন্ড ও ছাড়কার করে দিচ্ছে। এসব থেকে উত্তরণ না ঘটলে দেশের অর্জন, উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে ঠাঁই হয় তা কেহই সঠিকভাবে বলতে না পারলেও অভিজ্ঞজনদের মতে দুর্নীতি একটি বিষফোঁড়া হিসেবে চিহ্নিত। দেশে এমন কোনো সংস্থা, প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে দুর্নীতি নেই। দুর্নীতিবাজদের ঘাঁটি সেনাঘাঁটির মতো শক্তিশালী। তাদের বিরুদ্ধে কিছু বললে বা লেখলে উল্টো নিজের উপরই দায়ভার চলে আসে। কারণ দুর্নীতির নাটের গুরুদের সাথে এমন কিছু শক্তিধর ও শক্তিশালী গডফাদার থাকে যারা প্রতিনিয়ত নাটের গুরুদের রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকে। ক্যাসিনো কেলেংকারী উদঘাটন হওয়ার পর নাটের গুরুরা যাদের আশ্রয়, প্রশ্রয়ে সপ্তাহে, মাসে ও এককালীন গডফাদারদের কত টাকা দিয়েছে তা বলার পর আজও গডফাদার নামীয় দানব ও রাক্ষসদের স্বরূপ উদঘাটিত হয়নি। যার ফলে দুর্নীতির গডফাদাররা আরাম আয়েশেই জমিদার হরিবলের হালে দিনাতিপাত করে যাচ্ছে।
ব্রিটিশ আমলের পর পাকিস্তান আমলের ৫৬ ও ৬২ সালের সংবিধানের আলোকেও সিআরপিসির দৃশ্যপটে এখনও অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশে ফৌজদারী মামলা মোকদ্দমা পরিচালিত হচ্ছে। জেল কোডের কিছু ধারার সংস্কার হলেও এখনও ১৯৩০ সালের জেল
কোডের আইনের মাধ্যমে কারা ব্যবস্থাপনা চলে আসছে। যদিও বলা হয়ে থাকে “কারাগার রাখিব নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ”। তবে বাস্তবে স্বাধীন দেশের কারা ব্যবস্থাপনা নিয়ে যা শুনা যায়, যা অবর্ননীয় ও অপ্রত্যাশিত।
২০০৭ সালে বিচারক (জজ) মাসদার হোসেন মামলার আলোকে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ (Judicial Seperation) হলে আজও প্রকৃত পক্ষে বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ পৃথকীকরণ হয়নি বলে অনেক বিজ্ঞ আইনজীবীরা মনে করে থাকেন। অনেকে মনে করেন, আজও এডিএম কোর্ট, মোবাইল কোর্ট ও সাত ধারা কোর্ট নির্বাহীদের অধীনেই রয়েছে। এছাড়া লক্ষ্য করলে দেখা যায়, নির্বাহী এবং জুডিসিয়ালদের মধ্যে যেন স্নায়ুযুদ্ধ লেগেই আছে। যা কারও কাম্য নহে। কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলায় সিজেএম কোর্ট (Chief Judical Magistrate Court) করাকালীন সময়ে সেই ভবনে যাওয়ার পথে জেলা প্রশাসন অন্য একটি স্থাপনা করলে সুনামগঞ্জের আইনজীবী সভাপতিসহ অন্যরা এ ব্যাপারে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এমন ধরণের আরও অনভিপ্রেত ঘটনা অহরহ শুনা যায়। যা গণমাধ্যম, মিডিয়ায় প্রকাশ, প্রচার ও যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে থাকে। দেশের সার্কিট হাউজগুলো সিভিল প্রশাসনের লোকজন কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে। সার্কিট হাউজে কোন ক্যাটাগরির লোক থাকতে পারে এবং প্রাধিকার ভিত্তিতে কোন কক্ষকে ব্যবহার করবে এ নিয়েও রয়েছে নির্দেশনা Rules of presidence বা গাইড লাইন। সেখানেও নাকি অনেক সময় রুলস অব প্রেসিড্যান্স বা গাইড লাইন মেইনটেন্স হয় না বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বাস্তবেই যদি জনশ্রুতির প্রতিফলন হয়ে থাকে তবে তাতে দুঃখ, বেদনা, যাতনা ও আক্ষেপ না থাকার কথা নয়। জেলায় জেলা ও দায়রা জজ, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জনসহ অন্যান্য কর্মকর্তা থাকলেও জেলা ও দায়রা জজ পদাধিকার বলে পূর্ণ সচিবের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। কোনো অবস্থাতেই তা খাটো করে দেখার সুযোগ পরাহত।
২৭/১২/২০ ইং বাংলাদেশ প্রতিদিন এ “আমলাদের উৎসাহে সর্বনাশ হয়”, কলামে প্রথিতযশা একজন সাংবাদিক ও কলামিস্ট অতি উৎসাহিত আমলাদের ব্যাপারে কিছু কথা বলেছেন, যাতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা (Stgructural Interlocking) ফুটে ওঠেছে। কলামটিতে অনেক কিছু বলার মধ্যে লিখেছেন, অনেকের ভাবসাব, চালচলন স্বাভাবিক নয়। অনেকে মন্ত্রীর চেয়ে দাপটে। বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এমন একটা অহংকার তৈরী হয়েছে সিভিল প্রশাসনের। ভাবখানা এমন তারাই যেন দয়া করে সরকারকে ক্ষমতায় এনেছেন এবং টিকিয়ে রেখেছেন। আমলাদের দাপট প্রশাসনে সবকালেই ছিল। কিন্তু লাইম লাইটে মন্ত্রীরা থাকতেন। জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের সম্মানটা ছিল আলাদা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ এমপিও একটা মর্যাদা নিয়ে চলতেন। সংসদ দুর্বল হলে মন্ত্রীসভা ভালো হয় না। আর দুর্বল মন্ত্রীসভার কারণে আমলাদের ভাব বেড়ে যায়। অনেকের কথাবার্তায় মনে হয়, রাষ্ট্রের মালিক বনে গেছেন। রাষ্ট্রের মালিক দেশের জনগণ এবং সাংবিধানিকভাবে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। অন্য কেউ নয়। তারপরও কারও পরিমিতিবোধ না থাকলে সমস্যা। অনেক প্রভাবশালীর বক্তব্য বিবৃতিতে মনে হয় তারা নেতাদের চেয়েও বড় নেতা।
এ প্রসঙ্গে একটি শুনা ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়। একবার পাকুন্দিয়া কলেজের একজন অবসরপ্রাপ্ত সহকারি অধ্যাপক জেলা পর্যায়ের কোনো এক কর্মকর্তার নিকট কোনো কাজে তিন দিন অফিসে সাক্ষাৎ পাননি। চতুর্থ দিন তাকে পাওয়ার পর তিনি বললেন আপনার অফিসে তিন দিন এসে আপনাকে পেলাম না। চারদিনের মাথায় পেলাম। ইহা শুনে নাকি সেই কর্মকর্তা রাগে ফেটে পড়েন। আর বলেন, আপনার কথা আমি শুনবনা। আপনি যেখানে খুশী নালিশ করেন, আমি কাহাকেও ভয় পাই না। এই হল স্বাধীন ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জেলা পর্যায়ের একজন কর্মকর্তার আস্ফালন। এসব কিছু আস্ফালন ১৯৬ বছরের পরাধীন ব্রিটিশ ও ২৪ বছরের পাকিস্তানিদের তীর্যক ও অমার্জনীয় আস্ফালনকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল সভায় কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, আপনারা দেশের মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবেন না। তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করবেন।
অর্থাৎ তারা যে সাংবিধানিকভাবে প্রজাতন্ত্রের সেবক তা যেন ভুলে যেতে বসেছে। সংবিধানে রয়েছে Government of the Peoples Republic of Banlgadesh আর ওরা মনে করে ওরাই যেন দেশ বা প্রজাতন্ত্রের মালিক ও সর্বেসর্বা। আর দেশের জনগণ যেন তাদের সেবক ও তল্পিবাহক।
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশের রাজত্বকালে লর্ড রিপনের শাসনামলে ১৮৮৪ সালে Bengal Municpal Act পাসের মাধ্যমে বাংলায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান মিউনিসিপালিটি বা পৌরসভা সৃষ্টি হয়। গঠিত পৌরসভায় সে সময় কমিশনারের সংখ্যা ৯ এবং সর্বোচ্চ ৩০ জন নির্ধারণ করে দেয়া হয়। কমিশনারদের দুই তৃতীয়াংশ নির্বাচিত এবং এক তৃতীয়াংশ সরকার কর্তৃক মনোনীত করা হতো। কমিশনাররা নিজেদের মধ্য হতে একজনকে চেয়ারম্যান ও একজনকে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচন করতেন। সরকারের পূর্ব অনুমোদন নিয়ে পৌরসভা বিভিন্ন ধরণের কর, ফি, টোল ও পৌর কর আরোপ করতে পারত। সময়ের বিবর্তনে পৌরসভার কাঠামো এবং নির্বাচিত ব্যক্তিদের পদ ও পদবীতে নির্বাহী পদে নির্দলীয়ভাবে নির্বাচনে কোনো ব্যর্তয় ঘটেনি। ২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা আইনে সংশোধনী এনে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী পদে নির্বাচনে প্রার্থীকে কোনো রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনয়নের বিধান করা হয়। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিধানও রাখা হয়। এ সংশোধনীর ফলে পৌরসভার প্রধান নির্বাহী মেয়র পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য কোনো ব্যক্তিকে রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনীত বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহী পদে রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনয়নের বিধানটির প্রবর্তন সে সময় মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট, অন্যান্য বিরোধী দল এবং দেশের বিশিষ্টজনদের কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়।
নির্বাচন কমিশন নিবন্ধিত কমবেশী ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে তিন বড় দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। এখন আসন্ন পৌর নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরীর বিষয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলতে যা বুঝায় তা হচ্ছে কোনো নির্বাচনে তা জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হোক সর্বদল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ তৈরী করা। এ দায়িত্বটি মূলত নির্বাচন কমিশনের। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য গত কয়েক বছরে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরীর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কাজী রকিব উদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত অনেকটা অংশগ্রহণহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে। এই নির্বাচনে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে থাকে। কে.এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বহুদলীয় অংশগ্রহণমূলক হলেও এ নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরীর কোন চেষ্টা করেনি নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন পরবর্তী টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয় একমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারনায় তৎপর ছিল। নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ের মিডিয়া রিপোর্ট থেকে জানা যায় আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য বিরোধী দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি প্রার্থীরা কোনো নির্বাচনী প্রচারনায় তৎপর হওয়ার সুযোগ পায়নি। এছাড়া বিএনপির অগনিত নেতাকর্মীর নামে মামলা দিয়ে তাদের অন্তরীন রাখার ব্যবস্থা করা হয়। নির্বাচনী তফসিল জারির পরও এ অবস্থা চলতে থাকে। তাতে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা থাকা স্বত্বেও কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এ নির্বাচনে নজিরবিহীন অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। নির্বাচনে জয়ী হলে শাসক দল আওয়ামী লীগ চতুর্থবার সরকার গঠন করে থাকে।
দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মাঝখানে এবং একাদশ জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হয়নি। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রভাব পড়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনের ওপর। উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ২০১৪, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ২০১৫, পৌরসভা নির্বাচন এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ২০১৬ তে এর প্রভাব পড়ে। তখন ভোট কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, ভোট কেন্দ্র থেকে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর এজেন্টদের তাড়িয়ে দেয়াসহ অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। শাসক দল আওয়ামী লীগ মনোনীত/সমর্থিত প্রার্থীদের একচেটিয়া জয় হয়। সিইসি কাজী রকিব উদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও পরবর্তী সময় হুদা কমিশন এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে নিরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং পুতুল সিইসি হিসেবে অলংকিত হয়।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত খুলনা, গাজীপুর, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে। এসব নির্বাচনেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা হয়নি। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকায় চলতি বছরে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হওয়ায় জনগণ সব ধরণের নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে ভোট পড়ে যথাক্রমে ২৫ দশমিক ৩ ও ৩০ শতাংশ। মিডিয়ার সংবাদ অনুযায়ী চলতি বছরে অনুষ্ঠিত উপ নির্বাচনগুলোর মধ্যে ঢাকা- ১০, ঢাকা- ৫, ঢাকা- ১৮ আসনে ভোট পড়েছে যথাক্রমে ৫ দশমিক ২৮, ১০ দশমিক ৪৩ এবং ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। যা গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত।
১৮ ডিসেম্বর যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা বেশী। মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে বিএনপি প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারে যথেষ্ট হিমশিম খেতে হচ্ছে। ১৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসচিব ডেইল স্টারে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, বিএনপির ৩৫ লাখ কর্মীর নামে লক্ষাধিক মামলা রয়েছে। ২৮/১২/২০ ইং পৌর নির্বাচনেও নির্বাচন কমিশন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ধরে রাখতে পারে না বলে নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও অনেক কেন্দ্রে ব্যাপক দাঙ্গা হাঙ্গামার সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে থাকে।
যাতে সমস্যার সমাধান হয় এবং দেশের মানুষ যাতে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার কাংখিত স্বাদ গ্রহণ করতে পারে ইহাই পাথেয়। দেশের মানুষ চায় শাস্তি, স্বস্থি, নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতিফলন। লজ্জা শরম উজার করে ভূতের মুখে রাম নাম কারও প্রত্যাশা নহে। এমনিভাবে চললে আস্থা, বিশ্বাস তিরোহিত হলে কাহারও বলার কিছু নাও থাকতে পারে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকারই সব কিছুর উপরে অধিষ্ঠিত। এর বাইরে যাওয়ার ইতিহাস কারও জন্যেই শুভ নহে। পরিশেষে বলব, সামনে অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, কারচুপিমুক্ত ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড অনুসারে অনুষ্ঠিত হয়, দুর্নীতির আবসান, বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ পৃথকীকরণ এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার রোষানল থেকে মুক্তি পাওয়া যায় ইহাই মুখ্যম। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মহান স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রই আমাদের অহংকার। কথা, কাজ ও ইহার বাস্তব প্রতিফলনই জনপ্রত্যাশা। লজ্জা শরম ভুলে গিয়ে ভূতের মুখে রাম নাম আর শোভা পায় না।
লেখক: কলামিষ্ট