পাখির জন্য গাছে গাছে মাটির পাত্র স্থাপন। সেই বাসায় পাখি বাসা বাঁধছে, ডিম পাড়ছে ও বাচ্চা ফুটাছে। এ স্বপ্ন দেখে ছিলেন, পরিবেশবাদী সংগঠন বনবিবির সভাপতি। এখন সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। মাটির পাত্রে পাখি বাসা বাঁধায় সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে সাড়া পড়েছে।
খুলনার পাইকগাছা উপজেলা বিভিন্ন গাছে গাছে বাঁধা হয়েছে মাটির পাত্র, ছোট ঝুড়ি ও বাঁশের তৈরী বাসা। আর তাতে পাখিরা বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। উপজেলার সরল মেইন সড়কের পাশে বট গাছে বাঁধা মাটির পাত্রে শালিক বাসা বেঁধেছে, নতুন বাজারের পাশে বকুল ও মেহগুনি গাছে মাটির পাত্রে চড়-ই পাখি বাসা বেঁধেছে। গোপালপুর স্কুলের পাশের মেহগুনি গাছে দোয়েল পাখিরা বাসা বেঁধেছে। সংগঠনের সভাপতি সাংবাদিক প্রকাশ ঘোষ বিধান জানান, উপকূলের এ উপজেলায় পাখি সুরক্ষায় আবাসস্থল তৈরীর লক্ষ্যে গাছে মাটির পাত্র প্রথমে অনেকে সহজ ভাবে গ্রহণ করেনি। নানা কুটুক্তি, ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপও শুনতে হয়েছে। প্রথম বছরে গাছে বাঁধা প্রায় সব মাটির পাত্র গুলতি মেরে ও ইট পাথর ছুড়ে ভেঙ্গে দেওয়া হয়। এমন একসময় ছিল এ এলাকার শিকারীরা দল বেঁধে পাখি শিকারে মেতে উঠতো। আর শীতকাল আসলে তো পাখি শিকার মহাউৎসবে পরিণত হতো। শীতকালে জলাশয় ও ধানক্ষেতে ফাঁদ, জাল, বিষটোপ দিয়ে পাখি শিকার করা হতো। সংগঠনটি বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের পাখির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে লিফলেট ও পাখি রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টি করতে উদ্ভূদ্ধকরণ সভা করেন। এখন এলাকায় প্রায় সকলে পাখি রক্ষা বা আবাসস্থল সংরক্ষণের লক্ষ্যে গাছে মাটির পাত্র বাঁধায় সহযোগীতা করছেন। কেউ যাতে মাটির পাত্র ভেঙ্গে না দেয় তাও খেয়াল রাখছেন। পাখি যে মানুষের পরম বন্ধু তা তারা অনুধাবন করতে পেরেছে। পাখি পৃথিবীর ৮০ ভাগ কীটপতঙ্গ খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করছে। তারা জেনেছে পরিবেশের ভারসম্য রক্ষায় পাখির গুরুত্ব অপরিসীম।
এ উপজেলায় বণ্যপাখি সুরক্ষা, পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তোলা ও পাখির বাসার জন্য উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মাটির পাত্র স্থাপন করা হচ্ছে। বনবিবি নামের সংগঠনটি ২০১৬ সাল থেকে উপজেলার পৌরসভা, গদাইপুর, রাড়ূলী, হরিঢালী, কপিলমুনি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে পাখির জন্য গাছে গাছে মাটির পাত্র স্থাপন কার্য্যক্রম চালিয়ে আসছেন। পরিবেশ বান্ধব পাখিকূল রক্ষা, বিরল প্রজাতির বিলুপ্তি রোধ, নির্বিচারে শিকার বন্ধ, প্রজনন ও পাখিদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রগুলো নষ্ট না করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে স্ব উদ্যোগে তারা এই কাজটি করে চলেছে।
পরিবেশবাদি সংগঠন বনবিবির সভাপতি প্রকাশ ঘোষ বিধান আরো জানান, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে পাখির আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পাখি রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি ও এদের আবাসস্থল সুরক্ষায় পরিবেশবাদী সংগঠন বনবিবি বিভিন্ন কার্য্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জীববৈচিত্রকে সমৃদ্ধ করেছে পাখি। পরিবেশবান্ধব এই প্রাণীটি জীববৈচিত্রের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্পদ। জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের দ্বারা সৃষ্ট নানা কারণে পাখিরা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র রক্ষা এবং আমাদের সুস্থ্য জীবন ধারার জন্যও পাখিদের রক্ষা করা জরুরী। পাখিদের স্বাভাবিক প্রজনন ও তাদের সুস্থ্য জীবনধারাকে টিকিয়ে রাখতে সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি প্রয়োজন। পরিবেশ বান্ধব এই প্রাণীটিকে রক্ষা, বিরল প্রজাতির পাখির বিলুপ্তি রোধ, নির্বিচারে পাখি শিকার বন্ধ, প্রজনন ও পাখিদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রগুলো নষ্ট না করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে কার্য্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। সংগঠনটি এ পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন গাছে প্রায় ১২শ মাটির পাত্র স্থাপন করেছেন। তবে বিভিন্ন ঝড়সহ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে গাছের ডালপালা ভেঙ্গে প্রায় তিনশতাধিক মাটির পাত্র ভেঙ্গে গেছে। সেখানে নতুন পাত্র স্থাপন করেছেন।
উপজেলার পৌর সদরসহ আশপাশের ৩-৪টি ইউনিয়নের গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে গাছের ডালে ডালে বাঁধা হয়েছে মাটির ছোট ছোট কলস ও ঝুড়ি। এতে পাখির আনাগোনা বেড়েছে। গদাইপুর গ্রামের চাষী মোবারক ঢালী জানান, কৃষি জমিতে ব্যবহার করা হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক। এর ফলে বিষ আক্রান্ত পোকা মাকড় খেয়ে পাখিরা মারা যাচ্ছে। তাছাড়া ফাঁদ, বিষটোপ, ইয়ারগান, গুলতি দিয়ে পাখি শিকার করা হয়। তবে এখন শিকারীরা প্রকাশ্যে শিকার না করে রাতের বেলায় কৌশলে পাখি শিকার করছে। উপজেলার বন কর্মকর্তা প্রেমানন্দ রায় জানান, বনবিবির এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এর ফলে আমাদের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা হবে। পাখিরা ফিরে পাবে নিরাপদ আবাসস্থল। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী জানান, এটি একটি অসাধারণ উদ্যোগ। আমি নিজেই প্রাণীবিদ ও পাখিপ্রেমী। আমি এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত হতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করছি।