নির্বাচন, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র একই সূত্রে গাঁথা। অপরদিকে নির্বাচনে ভোটাধিকার হরণ মানেই গণতন্ত্রের বুকে ছুরি চালানো। যা গণতন্ত্র হত্যার দলিল হিসেবে আখ্যায়িত। ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট ব্রিটিশের ১৯৬ বছরের পরাধীনতা হতে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে পাকিস্তানের একনায়ক ও শোষক গোষ্ঠি এদেশের মানুষকে শোষণ, লুন্ঠন ও বারবার প্রহসনের নির্বাচন ও ভোটাধিকার হরণের মাধ্যমে একনায়কের প্রভুত্ব সৃষ্টি করে থাকে। এরই মধ্যে পাকিস্তানের সেনানায়ক আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জাকে বন্দুকের নলের মাধ্যমে সরিয়ে দেয় এবং তৎপরবর্তী সময়ে সামরিক শাসক ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজেকে অলংকিত করে থাকে। যা অনেকটা বাংলাদেশের সেনা প্রধান লেঃ জেঃ এইচ.এম এরশাদের ক্ষমতা হরণের সাথে তুলনা করা চলে। তারপর আইয়ুব খান গণতন্ত্রকে হত্যা করে Basic Democracy বা পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে বুনিয়াদী গণতন্ত্রের আদলে মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে থাকে। যা ছিল গণতন্ত্র হত্যারই নামান্তর বা করষষরহম Killing Democaracy। তাতে এদেশের মানুষ গণতন্ত্রের মুক্তির লক্ষ্যে বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে রাজপথে আন্দোলন, সংগ্রাম ও ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করে থাকে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অর্থাৎ ৪৯ বছরে অনেক ধরণের সরকার গণতন্ত্রের কথা বলে ক্ষমতায় আসলেও আজও দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়নি। তদোপরি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যা ভূতের মুখে রামনাম জপারই শামিল। এ পর্যন্ত দেশে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন কিভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন, ইসি ও সিইসি কী ধরণের ভূমিকা রেখেছে তাও কামবেশী সবারই জানা। নতুন করে পূর্বের নির্বাচনের আমলনামা, ভোটাধিকার হত্যা, গণতন্ত্র হত্যা, অস্বচ্ছ, অগ্রহণযোগ্য, কারচুপির হালহকিকত, ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও বিজয়ী প্রার্থীকে পরাজয় দেখিয়ে বলীর পাঁঠা বানানোর কাহিনীও ভুলে যাওয়ার নহে। যার রয়েছে বিভিন্ন নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ সংস্থা ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত উড়পঁসবহঃধৎু ঊারফবহপব বা দালিলীক প্রমাণ। যা তুলে ধরলে গণতন্ত্রকামী সুষ্ঠু চিন্তার বিবেক সম্পন্ন মানুষের স্থির থাকার কথা নয়। দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন, জাতীয় উপ-নির্বাচনসহ ২০১৬ সালে মৌলিক গণতন্ত্রের আদলে যে একতরফা জেলা পরিষদ নির্বাচন হয়ে গেছে তাও সবারই দেখা ও জানা। তখন সিইসি কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ ও পরবর্তী সময় সিইসি এ.কে.এম নূরুল হুদা অন্যান্য কমিশনাররা যে সংবাদ সম্মেলনসহ অন্যান্য পর্ষদে বক্তৃতা, বিবৃতিতে ধান ভানতে শিবের গীতের মতো নির্বাচনের প্রশংসা ও সাফাই করে যে খেতাব অর্জন করেছেন তাও দেশের নানা শ্রেণী পেশার মানুষসহ রাজনীতিক ও গণমাধ্যম কর্মীদের না জানার কথা নয়। যা একদিন হয়তোবা ইতিহাসের পাতায় দালিলীক প্রমাণ হিসেবে মহীরূহ হিসেবে দেখা দিলেও বলার বা প্রতিবাদ করার মতো তেমন কিছু নাও থাকতে পারে। ইতিহাস খুবই বিষ্ময়কর। যার যা প্রাপ্তি থেকে কেহ বাদ পড়ে না।
বর্তমান দেশের চারটি ধাপে যে পৌরসভা নির্বাচন হচ্ছে এ ব্যাপারে কিছু আলোকপাত না করলেই নয়। প্রথম ধাপের ২৪টি পৌরসভা নির্বাচন ২৮ ডিসেম্বর হয়ে গেছে। বাকী তিনটি ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে যথাক্রমে ১৬ জানুয়ারি ৬১টি পৌরসভায়,
তৃতীয় ধাপে ৩০ জানুয়ারি ৬৪টি পৌরসভায় ও চতুর্থ ধাপে ১৪ ফেব্রুয়ারি ৫৬টি পৌরসভায়। এ ব্যাপারে ২৮ ডিসেম্বর ২৪টি নির্বাচনী এলাকার নির্বাচনে বিএনপি, অন্যান্য দল কারচুপি, গণমাধ্যমে বিশৃঙ্খলা ও ভোট কেন্দ্র দখলের অভিযোগ আনলে নির্বাচন কমিশন ও সিইসি তাতে স্বচ্ছ ও বিশৃংখলামুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাফাই সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে। যা শোভনীয় নয় বলে অনেকেরই বক্তব্য। এ ব্যাপারে সাংবিধানিক ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসি ও সিইসির বাস্তবতার দৃশ্যপট গণমাধ্যমে তুলে ধরা উচিত ছিল বলে রাজনৈতিক দল, দেশের বিজ্ঞজনদের প্রত্যাশা আদৌ কম ছিল না। তাতে পৌরসভা নির্বাচনের পরবর্তী ধাপে বড় রকমের আশংকা সৃষ্টি হয়েছে। বাকি তিনটি নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা যাতে আর কেহ বলীর পাঁঠা না হয় ইহাই হয়তো দেখার বিষয়। কারণ ইসি ও সিইসি কোনো ধরণের নির্বাচনেই সাফাই সার্টিফিকেট দিয়ে কোনো দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীকে বলীর পাঁঠা বানানো কারও কাম্য নহে। মনে রাখা উচিত স্বচ্ছ নির্বাচন যেমন ভোটাধিকারকে সুসংসহত করার অগ্রানোগ্রাম, তেমনি কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন ও জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে হেলাফেলা, তামাশা ও বনভোজন খেলা করা উচিত নয়। এই নির্বাচনের সাথে জড়িত রয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করার পদধ্বনি। যা এড়িয়ে যাওয়ার ফলাফল যেমন দুর্বিসহ তেমনি গণতন্ত্রের জন্য মহাবিপদাপন্ন। একদিন আগে আর পরে হোক ইহা কাহাকেও ক্ষমা করে না। এছাড়া ক্ষমতা যেমন কারও জন্য স্থায়ী হয় না, তেমনি আগে আর পরে হোক ক্ষমতা থেকে সরে আসতেই হয়। যার রয়েছে অজ¯্র প্রমাণ, দৃষ্টান্ত ও উদাহরণ।
হিটলার, মুসোলিনি, জার, চেয়াংকাইশাক, হালাকু খান, নাদিরশাহ, চেংগিস খান, তৈমুর লং, টিক্কা, ইয়াহিয়া, চসেস্কু এবং তারও অনেক আগে নমরূদ, কারূন, ফেরাউন (রামেসিস) সহ আরও অনেকেই জনগণের অধিকার হরণ করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। জল্লাদ ইয়াহিয়া মদ্যপ অবস্থায় পানি পানি করতে গিয়ে মারা যায়। আজও বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের কবরের পাশ দিয়ে যাওয়া আসার সময় মানুষ জুতা নিক্ষেপ করে এবং থু থু দিয়ে থাকে। ফেরাউন নীলনদের পানিতে নির্মমভাবে মারা যায়। কারুণ ও নমরূদের নির্দয়ভাবে মৃত্যু হয়। সিকিমের লেন্দুম দর্জি ভারতে নির্বাসনে থেকে রোগে, চিকিৎসা ও খাদ্যের অভাবে এমনকি সঙ্গী ছাড়া নির্মমভাবে মারা যায়। হিটলারের মৃত্যু আজও অনোদঘাটিত। এজিদ মৃত্যুর আগে বলে যায়, তার কবর কোথায় দেয়া হয়েছে তা যেন দেশের মানুষ জানতে না পারে। তা জানলে তার হাড়গোর মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হবে। ঐতিহাসিক গীবনের মতে তৈমুর লং যখন দিল্লী আক্রমন করে তখন রাস্তার দুপাশের ড্রেনগুলো মানুষের রক্ত উছলিয়ে রাস্তা দিয়ে রক্ত¯্রােত প্রবাহিত হয়। ১৫ দিন পর্যন্ত দিল্লীর আকাশে একটি পাখিও দেখা যায় নি। সেই তৈমুর লং না খেয়ে অর্ধাহারে অনাহারে এবং চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। পাষন্ডদের বিরুদ্ধে এর নির্মমতার উদাহরণ আর কিই বা হতে পারে। তাই বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট তার মৃত্যুর আগে বিশ্বস্থ সেনানায়ক সেলুকাসকে বলে গিয়েছিল আমার মৃত্যুর পর কাফনে দুটি হাত উন্মোচিত করে রাখিও। জগৎবাসী দেখুক আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট খালি হাতে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে যাচ্ছে।
ব্রিটিশ আমলের কথা। তখন স্থানীয় সরকারের এক ইউপি নির্বাচনে সরকার পক্ষের সমর্থিত প্রার্থী ভোট গণনাকালে প্রায় পরাজয়ের পথে এবং তা দেখে জনৈক কর্মকর্তা ভোট গণনা স্থগিত করে দেয়। পরে ভোট গণনা করে সম্ভাব্য প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা করা হয়ে থাকে। সরকার পক্ষের প্রার্থীর ঘটনায় এই কর্মকর্তাকে সাধুবাদ না জানিয়ে তিরস্কার করে এবং এ কেলেংকারীর জন্য উক্ত কর্মকর্তাকে অপসারণ ও যথাযথ শাস্তি প্রদান করা হয়ে থাকে। একটি পরাধীন দেশে এমন অবস্থা হলেও আজ স্বাধীন দেশের নির্বাচনে অহরহ সরকার দলীয় প্রার্থীকে এমনিভাবে জয়ী এবং জয়ী প্রার্থীকে বলীর পাঁঠা বানানোর কথা শুনা যায়। এ ব্যাপারে নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের শাস্তি না দিয়ে বরং তাদের অপকর্মের জন্য মারহাবা, পদোন্নতি ও ধন্যবাদ জানানোর কথা কম শুনা যায়নি। এমনকি এ ধরণের অপকর্ম করার পর নির্বাচনের ফলাফলের ওপর সাফাই ও ধন্যবাদ জানিয়ে অনেকেই সংবাদ সম্মেলন করতে লজ্জাবোধ করেনি। যে কাজটি করতে পরাধীন ব্রিটিশ আমলে নিরোৎসাহিত করা হয়ে থাকে আর সে অনিয়মটিকে বর্তমান ও আগের অনেক ইসি ও সিইসি সাফাই ঈবৎঃরভরপধঃব দিয়ে উৎসাহিত করতে দ্বিধা সংকোচ বোধ করেনি। যে কারণে আরও অবশিষ্ট তিনটি পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে জনগণ, ভোটার ও দেশবাসীর মাঝে যথেষ্ট আশংকা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইসি ও সিইসির এই ট্রেন্ড ও উৎসাহ নির্বাচন কমিশনকেই শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, সরকারকেও অকপটে আলোচনা সমালোচনার দ্বার প্রান্তে নিয়ে আসছে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের ইসি, সিইসি, প্রিসাইডিং, পুলিশ, ইউএনও, ওসি, ডিসি ও এসপিকেও অনেকেই উপজেলা, জেলার সরকারি দলের খয়ের খাঁ, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মতো এ ন্যাক্কারজনক ব্যাপারে যা বলার বা করার তা করতেও কম শুনা যায়নি। যদিও অশুভ, এ নষ্ট অগণতান্ত্রিক ও বেলাল্লাপনা কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকা ও জড়িত না হওয়াটাই উচিত।
ইতিহাস ও বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অতি উৎসাহি হয়ে ও সরকারকে খুশী করার জন্য যে বা যারা নির্বাচনে অনেককে বলীর পাঁঠা ও ভোটাধিকার হরণ করে সাফাই দেয় সরকার পরিবর্তনে তাদের তেমন খেসারত দিতে হয় না বরং সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে এ শ্রেণীটা সাপের মতো খোলস পাল্টাতে সময়ের কালক্ষেপন হয় না। ওদের কোনো নির্দিষ্ট নীতি, আদর্শ ও দর্শন নেই। যেখানেই ক্ষমতা সেখানেই তাদের ভূমিকা বেনিআসহকলা বা ইরামুড়ৎ এর মতই। তাতে ক্ষমতার পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় রাজনীতিকরা। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে যারা জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে বিভিন্ন নির্বাচনে যারা জয়লাভ করে এবং কোনো কারণে যদি গণতান্ত্রিকভাবে তাদের ক্ষমতার পরিবর্তন হয় তখন তাদের বঞ্চনার শেষ থাকেনি।
৮৮, ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের কথা দেশের মানুষ আজও ভুলে যেতে পারেনি। যারা এ সমস্ত প্রহসনের নির্বাচনে সংসদ সদস্য ও অন্যান্য নির্বাচনে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন এবং ক্ষমতায়
রয়েছেন চলাফেলায় তাদের যে অসুবিধা, গলগ্রহ ও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, কী ধরণের ব্যাথা, বেদনা, যাতনা পোহাতে হয় তাদের ছাড়া অন্যদের তা বুঝানো বাস্তবিকই জটিল, কঠিন ও ডিফিকাল্ট।
ভোটারবিহীন এ ধরণের প্রহসনের নির্বাচনে বিজয়ী একাধিক বিভিন্ন পর্যায়ের সাবেক জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের মধ্যে অনেকেই সুখে নেই। তাদের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অনেকেই অহেতুক প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে জর্জরিত করে থাকে। যা দেখে ওরা কোনো অনুষ্ঠানে গেলেও তড়িঘড়ি সেসব অনুষ্ঠান ত্যাগ করে চলে আসার উপক্রম হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে একজন সাবেক এমপি বলে থাকেন “কি যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে, কভু আশি বিষে দংশেনি যারে।” অর্থাৎ ক্ষমতার জোরে এ সমস্ত প্রহসন ও ভোটারবিহীন নির্বাচনে জয়লাভ করার চেয়ে না করাই ভালো ছিল। এ বিড়ম্বনার চেয়ে যাতনা, বেদনা ও অনুশোচনার যেন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। প্রহসনের নির্বাচনে যারা ৭১ সালে হানাদারদের এমপি, এমএনএ, ৮৮ সালে এমপি, ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এমপি হয়েছিল তাদের যেন ভোগান্তির শেষ থাকেনি। যা ব্যাখ্যা বিশ্লেষনের কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
মোদ্দাকথা প্রহসনের নির্বাচনে জয়লাভ ও ক্ষমতায় যাওয়ার পর তাদের অন্তর্নীহিত সমস্যার যেন শেষ নেই। জনগণ যেমন তাদের যথাযোগ্য সম্মান দেখায়নি তেমনি অফিস আদালতেও একই অবস্থা দৃশ্যমান হয়ে থাকে। এছাড়া জনগণের ভোটে নির্বাচিত বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিদের মর্যাদা ও সম্মানের যেন শেষ থাকেনি। তাদেরকে দেশের জনগণ যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে স্মরণ করে থাকে। তাদের জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীতে তাদের স্মৃতিস্তম্ভ ও কবরে শত শত নারী পুরুষ ও শিশুরা পুষ্পার্ঘ্য অর্পন করে থাকে। তাদের উদ্দেশ্যে আলোচনা সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে মানুষের ঢল নামে। যার উপমা, উদাহরণ ও দৃশ্যপটের যেন শেষ থাকেনি।
১৯৭০ এর জাতীয় নির্বাচনে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) সংখ্যা গরিষ্ট সংসদ সদস্যদের জয়লাভের মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয় এবং বিশ্ববাসী স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে অভিবাদন জানায়। আর পরাজিত ৯৩ হাজার হানাদার বাহিনী ও নাটের গুরু নিয়াজি, টিক্কা, রাও ফরমানআলীসহ ১৯৫ জন নাটের গুরু যুদ্ধপরাধী আত্মসমর্পন করে থাকে। তাই ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ক্ষমতা বন্দুক, কামান, ট্যাংক, ডিনামাইট ও পারমানবিক বোমার চেয়ে কোনো অংশে কম নহে। গণতন্ত্র সুরক্ষা ও ভোটাধিকার সংরক্ষণ, আমার ভোট আমি দিব, যাকে খুশী তাকে দিব এ প্রবনতা সচল রেখে তোমার ভোটও আমি দিব এ প্রবনতা থেকে দূরে থাকাই বাঞ্চনীয়। নির্বাচনে ভোটাধিকার সংরক্ষণই গণতন্ত্রের মূল কথা। এর বাইরে যাওয়া কোনো মতেই গণতন্ত্র ও সংবিধান সম্মত নহে।
যে কোনো নির্বাচনে কোনো ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও ভোট হরণের মাধ্যমে কোনো প্রার্থী যাতে বলীর পাঁঠার শিকার না হয় তা যেমন জনপ্রত্যাশা ও গণতন্ত্রের মূল কথা তেমনি অস্বচ্ছ, অগ্রহণযোগ্য, কারচুপি, ব্যালট বাক্স দখল ও ভোট কেন্দ্র দখলের ঘটনা যাতে না ঘটে তাহাও কম প্রত্যাশা নহে। তদোপরি সমালোচিত ইভিএম বা ঊষবপঃৎড়হরপ ঠড়ঃবরহম গধপযরহব সম্পর্কেও থাকতে হবে সতর্ক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইভিএম নিয়েও রয়েছে আলোচনা, সমালোচনা ও সন্দেহ। নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীকে পরাজিত ও পরাজিত প্রার্থীকে জয়ী ঘোষনা করে ইসি, সিইসির সাফাই ও সংবাদ সম্মেলন কারও কাম্য হতে পারে না। ভোট হোক স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য এবং ইসি সিইসির ভূমিকা হোক স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ। কারও জয় ও পরাজয় নিয়ে ইসির সাফাই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিরপেক্ষতা হারানোরই নামান্তর। তাতে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার সুযোগ একেবারেই পরাহত। যদি ইসি ও সিইসি কারও জয় পরাজয় নিয়ে সাফাই, বেসামাল ও অগণতান্ত্রিক কোনো মন্তব্য করে থাকে, তবে ইসি এবং সিইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠলে তখন গ্রহণযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা আর থাকে না। তদোপরি আমার ভোট আমি দিব প্রবিধানের সাথে তোমার ভোটও আমি দিব এই অগণতান্ত্রিক প্রবিধান সংযুক্ত হলে ইসি সিইসির সাফাইয়ের মধ্যে কেহ যদি হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ এবং ইসি সিইসিকে নিয়ে কানার হাট বাজার বলে কেহ মন্তব্য করে তবে হয়তো দোষের কিছু না থাকারই কথা। নির্বাচনের বলীর পাঁঠা, ভোটাধিকার হরণ ও ইসি সিইসির সাফাই সার্টিফিকেট প্রবনতা থেকে সরে এসে স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য, ভোটাধিকার হরণ ও ভোট কেন্দ্র দখল ব্যতিরেখে ভোট অনুষ্ঠানই মুখ্যম। পরিশেষে ইসি ও সিইসির উদ্দেশ্যে বলব, এদেশ আপনার, আমার ও সকলের। দেশের প্রতি দরদ, দয়ামায়া কোনো অংশে ইসি ও সিইসির কম থাকার কথা নয়। দয়া করে সাংবিধানিক, গুরুত্বপূর্ণ ও নিরপেক্ষ দায়িত্বে থেকে নির্বাচনের ফলাফলে কাহাকেও খুশী ও কাহাকেও অশ্রুসিক্ত করা নয়। নির্বাচনে জয় পরাজয়ের পরও ইসি ও সিইসির প্রতি যাতে দোষারোপ ও পক্ষপাতিত্বের স্লাগা না আসে, নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতার জয়ধ্বনি প্রতিফলিত হয় ইহাই হোক কামনা, বাসনা ও আকাংখা। সাংবিধানিক ও নিরপেক্ষ পদ হিসেবে কাহার পক্ষে বা বিপক্ষে গিয়ে কাহাকেও নির্বাচনে বলীর পাঁঠা বানানোর প্রচেষ্টা অসাংবিধানিক বা টহপড়হংঃরঃঁঃরড়হধষ প্রজ্ঞারই নামান্তর। আগামী তিনটি পৌরসভার নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয় ইসি ও সিইসির প্রতি ইহাই মিনতি ও জনপ্রত্যাশা।
এ.কে.এম শামছুল হক রেনু
লেখক কলামিষ্ট