রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী পৌরসভার বর্তমান মেয়র মুক্তার আলী। তবে তিনি আসন্ন ১৬ জানুয়ারির নির্বাচনের ভোট যুদ্ধে লড়াই করছেন নৌকার বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী হিসেবে। মেয়র হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন অপকর্ম পরিচালনার দায়ে এবার তিনি নৌকার মাঝি হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন। এরপরও দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে নিজের ইমেজ পূনরায় ফেরানোর চেষ্টার বিপরীতে ভোটের মাঠে নেমেছেন নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে। ফলে ইতিমধ্যেই তিনি দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। বর্তমান মেয়র থাকা অবস্থাতেও আসন্ন নির্বাচনে তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয় প্রার্থী হিসেবে ছিটকে পড়ার কারণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ভয়াবহ অনেক চিত্র।
জানা গেছে, এই মুক্তার আলীর কুখ্যাতি নাম অর্জনের পেছনে রয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকা- পরিচালনার জন্য নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী তৈরি করা। যে বাহিনীর মাধ্যমে এলাকায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। আর এসব বিতর্কিত কর্মকা- পরিহারের লক্ষ্যে পরামর্শমূলক সমালোচনাকারীদেরকে মেয়র মুক্তারের নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী দিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হয়। এক্ষেত্রে সমালোচনাকারীগণ নিজ দলীয় নেতা-কর্মী হলেও কোন ছাড় দেন না মুক্তার। অভিযোগ রয়েছে, সমালোচকগণ নিজ দলীয় নেতা-কর্মী হলে ভয়ভীতি দেখিয়েই তিনি ক্ষান্ত হন না বরং তাদেরকে নানা অজুহাতে হয়রানী করা হয়। আর তুচ্ছ কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যার সমাধান না করিয়ে নিত্যদিনের খরচের যোগান হিসেবে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের জন্য সেটিকে ইস্যু বানিয়ে বড় জটলা সৃষ্টি করেন। এক্ষেত্রেও দলীয় কর্মীসহ সাধারণ মানুষের প্রতি তিনি একই ভুমিকা পালন করে থাকেন। আর চলতি পথে সৃষ্ট তুচ্ছ কারণে সাধারণ মানুষকে মারপিট ও নির্যাতন করা মেয়র মুক্তারের নিত্য ঘটনা বলেও অভিযোগ এলাকাবাসীর।
তবে করোনাকালে হতদরিদ্র দুই ত্রাণপ্রার্থীকে মারপিট করেই নাকি ব্যাপক আলোচনায় আসেন তিনি। তখনও অজ্ঞাত খুঁটির জোরে তার বিরুদ্ধে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। যদিও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অভিযোগ মুক্তারের বিরুদ্ধে নতুন কিছু নয়। তিনি ছিলেন পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তবে এবার বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার কারণে ইতিমধ্যেই তিনি দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। বেপরোয়া মুক্তারের ক্যাডার বাহিনীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হবে এমন ভয়ে তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। এমন কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ দিলেও অজ্ঞাত কারণে প্রশাসন নির্বিকার ভুমিকায় থাকায় আড়ানীর মানুষ সবসময় আতঙ্কে থাকেন বলেও অভিমত এলাকার বিশিষ্ঠজনদের।
বেপরোয়া মেয়র মুক্তারের ক্যাডার বাহিনীর ছোবল থেকে রক্ষা পান নি গণমাধ্যম কর্মীরাও। গত শুক্রবার দুপুরে পৌর নির্বাচনের খবর সংগ্রহ করতে রাজশাহী থেকে আড়ানীতে গিয়েছিলেন মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের ক্যামেরাপারসন মাহফুজুর রহমান রুবেল ও দীপ্ত টিভির ইসলাম উদ্দিন। সে সময় পেশাগত দায়িত্বপালনকালে তাদের ওপর হামলা করে মুক্তার বাহিনীর ক্যাডাররা। এ সময় পিটিয়ে তাদের আহত করা হয়। একই সময়ে জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক বিপাশা খাতুনসহ নারী কর্মীদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়।
পরে এলাকাবাসী ছুটে গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। এত কিছুর পরও পুলিশ এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। আর মুক্তার বাহিনীর ক্যাডার মিলন, সেলিম, বিদ্যুৎ, রাজন, রাজু ও ফারুকের বিরুদ্ধে বাঘা থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। তবে এ বিষয়ে বাঘা থানার কর্মকর্তা ইনচার্জ (ওসি) নজরুল ইসলামের দাবি তিনি কোনো অভিযোগই পাননি।
এ ঘটনায় আড়ানী পৌরসভার আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী শহীদুজ্জামান শাহীদ বলেন, এত বড় ঘটনার পরও মুক্তার বাহিনীর ক্যাডারদের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মুক্তারের ক্যাডাররা নৌকা প্রতীকের কর্মীদের ওপর বিভিন্ন স্থানে হামলা করছে। তাদের নির্বাচনী মাঠে নামতে দেয়া হচ্ছে না। পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছে, প্রচারে বাধা দিচ্ছে। এসব ঘটনায় লিখিত অভিযোগ দিলেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনের বিপরীতে প্রশাসন নিরবতা পালন করছে।
এদিকে প্রশাসনের এমন ভুমিকা দেখে দলীয় নেতা-কর্মী ও ভোটাররা রীতিমত শঙ্কার মধ্যে পড়েছে। অনেকেই বলছে, ক্ষমতাসীন সরকার দলীয় প্রার্থীর পাশে প্রশাসনকে শেষ সময়েও না পাওয়া গেলে দলীয় অন্তদন্দ্বের কারণে ভোটের ফলাফল বিরোধী দলের পক্ষে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মেয়র হওয়ার পর থেকে মুক্তার আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। একসময়ের গরুর হাটের টোল আদায়কারী মুক্তার এখন পৌরসভার টিয়াডা পাড়ায় বানিয়েছেন আলিশান বাড়ি। প্রশাসনের প্রশ্রয়ে তিনি ভয়ংকর অরাজক পরিস্থিতি ও একের পর এক অপকর্মে জড়িয়েছেন। আর এ কারণে দল তাকে এবার মনোনয়ন দেয়নি। স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতা শহীদুজ্জামান শাহীদকে মেয়র পদে মনোনয়ন দিলেও মুক্তারের ক্যাডার বাহিনীর কারণে তিনি আড়ানীতে ঠিকমতো প্রচার চালাতে পারছেন না। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শাহীদের অভিযোগ-মুক্তার বাহিনী আড়ানীতে নৈরাজ্য কায়েম করেছে। জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৫ এপ্রিল পৌরসভার মাসিক সভায় ১২ জন কাউন্সিলর মুক্তারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও সরকারি সহায়তা কর্মসূচির বিপুল অর্থ লোপাটের অভিযোগ তোলেন। এ সময় মুক্তার ক্ষিপ্ত হয়ে এক কাউন্সিলরকে মারপিট করে। এ ঘটনায় কাউন্সিলররা একযোগে মুক্তারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে অভিযোগ করেন। অথচ সে ঘটনাতেও প্রশাসন ছিল নির্বিকার।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে মেয়র মুক্তার বলেন, তাকে ফাঁসাতে স্থানীয়ভাবে তার বিরুদ্ধে দলের একটি অংশ সক্রিয়। অতীতের ঘটনাগুলোও তার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অপপ্রচার ছিল দাবি করে মুক্তার বলেন, নৌকার ভরাডুবি হবে তা বুঝতে পেরে আমার বিরুদ্ধে বদনাম ছড়ানো হচ্ছে।
বাঘা উপজেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয় ধাপের চলমান আড়ানী পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪ জন। এতে সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী ২৯ জন ও সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ড কাউন্সিল প্রার্থী ১০ জন। আগামী ১৬ জানুয়ারী ৯টি ওয়ার্ডে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এ পৌরসভায় মোট ভোটার সংখ্যা ১৩ হাজার ৮৮৪। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ হাজার ৮৭৮ ও নারী ভোটার ৭ হাজার ১০৬ জন। গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দের পর প্রচারণায় সরগরম হয়ে উঠে আড়ানী পৌর এলাকা।