বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন ১১ পরিশোধনাগার পেট্রলের মান উন্নয়ন করতে পারেনি। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) দেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলোয় পাওয়া কনডেনসেট থেকে উৎপাদিত জ্বালানি তেল পেট্রলের মান পুননির্ধারণ করে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল। তাতে পেট্রলের রিসার্চ অকটেন নম্বর (আরওএন) ৮৯ করা হয়। সেই সঙ্গে গুণমান নিশ্চিত করতে বিএসটিআই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) গত বছরের জুনে চিঠি দেয়। কিন্তু তারপর ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও পেট্রলের মান উন্নয়ন করা সম্ভব হয়নি। উল্টো পরিশোধনাগারগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পেট্রলের মান আগের মানদ- আরওএন ৮০-তে ফিরিয়ে নিতে ইতিমধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়কে বিএসটিআই সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে। বিএসটিআই সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের সরকারি জ্বালানি তেল শোধনাগারগুলো বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মান অনুসরণ করতে না পারায় গত কয়েক মাস ধরেই বন্ধ রয়েছে। আর সরকারি শোধনাগার বন্ধ থাকায় বেসরকারি ৩ প্রতিষ্ঠানে গ্যাসের উপজাত (কনডেনসেট) থেকে জ্বালানি তেলে রূপান্তর করা হচ্ছে। গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে উপজাত হিসেবে ন্যাচারাল গ্যাস লিকুইডস (এনজিএল) ও কনডেনসেট পাওয়া যায়। শোধনাগারে ওই কনডেনসেট রূপান্তরের মাধ্যমে তৈরি হয় কেরোসিন, ডিজেল, পেট্রল ও অকটেন। আর এনজিএল থেকে তৈরি হয় এলপিজি। পরিশোধিত জ্বালানি তেলের মধ্যে মূলত পেট্রলের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সিলেটের গোলাপগঞ্জে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) দুটি ফ্রাকশনেশন প্লান্ট, সিলেট গ্যাস ফিল্ড লিমিটেডের অধীনে হরিপুর ও কৈলাশটিলায় দুটি এবং রশিদপুরে আরো দুটি প্লান্ট রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডের অধীনে কুমিল্লায় রয়েছে অকটেন, পেট্রল ও ডিজেল উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন আরো একটি প্লান্ট। সরকারি ওসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও সুপার পেট্রোকেমিক্যাল, পেট্রোমেক্স ও অ্যাকোয়া নামে তিনটি বেসরকারি শোধনাগারে জ্বালানি তেল রূপান্তর করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম ও ঘোড়াশালে ওসব প্লান্টের অবস্থান।
সূত্র জানায়, বিগত ২০১২ সালে পেট্রলের আন্তর্জাতিক মানদ- রক্ষায় সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই সময় থেকে দীর্ঘ ৯ বছর পেরিয়ে গেছে। ওই সময়েও রিফাইনারিগুলো পেট্রলের মান সূচক উন্নয়ন করতে পারেনি। পেট্রলের মান উন্নয়ন না হওয়ায় দেশের যানবাহনের স্থায়িত্ব, মাইলেজ এবং পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পেট্রলের মান না বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন সংশোধন করে পেট্রলের মান কমানো হলে সেটি আরো ক্ষতিকর হবে। বাজারে নিত্যনতুন যানবাহনও ওই তেলের কারণে ক্ষতির মুখে পড়বে। একই সঙ্গে দেশে পেট্রল পাম্পগুলোর সঙ্গে গ্রাহকের বিবদমান সমস্যাও আরো প্রকট হবে। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী পেট্রলে রিসার্চ অকটেন নাম্বার (আরওএন) অন্তত ৮৭ থাকতে হয়। সে অনুযায়ী রিফাইনারিগুলোর জন্য পেট্রলে আরওএন ৮৭ মাত্রায় রাখার বাধ্যতামূলক করে বিএসটিআই। কিন্তু বেসরকারি খাতের ১৩টি রিফাইনারির (কনডেনসেট ফ্র্যাকশনেশন প্লান্ট) মধ্যে ১১টি ওই মান অনুযায়ী পেট্রল উৎপাদন করতে পারে না। তাদের পেট্রলে আরওএনের পরিমাণ ৮০-এর বেশি থাকে না। বরং অনেক সময় তা আরো কমে যায়।
সূত্র আরো জানায়, পেট্রল ও অকটেনের মান ভালো না হওয়ায় ভোগান্তিতে রয়েছে দেশের পেট্রল পাম্পগুলো। তেল নিয়ে গ্রাহকের সঙ্গে বাকবিত-া এবং বিভিন্ন সময়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে পেট্রল পাম্প মালিকদের জরিমানার সম্মুখীন হতে হয়। এ বিপত্তি এড়াতে সঠিক মানের পেট্রল সরবরাহে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার্স, ডিস্ট্রিবিউটর্স, এজেন্ট অ্যান্ড পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির সভাপতি সৈয়দ সাজ্জাদুল করিম কাবুল জানান, পাম্পে মানসম্পন্ন পেট্রল সরবরাহে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে। কারণ পাম্প সংশ্লিষ্টদের প্রায়ই গ্রাহকের সঙ্গে পেট্রল-অকটেন নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়াতে হয়। যদিও পাম্পগুলো এর উৎপাদক নই।
এদিকে পেট্রোকেমিক্যাল অ্যান্ড রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (পিআরএবি) গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি শিল্প মন্ত্রণালয়ে পেট্রলের মান কমাতে (আরওএন ৮৭ থেকে ৮০) একটি আবেদন করে। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প মন্ত্রণালয় ওই বছরের ১৬ মার্চ বিএসটিআইকে পেট্রলের মান সূচক কমাতে নির্দেশনা দেয়। পিআরএবির আবেদন ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি পর্যালোচনায় গত সেপ্টেম্বরে বৈঠক করে ‘মিনারেল, ফুয়েলস অ্যান্ড পেট্রোলিয়াম প্রডাক্টস’ শাখা কমিটি। বৈঠকে দেশের জাতীয় ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বন্ধ থাকা রিফাইনারিগুলো খুলে দেয়ার জন্য বিপিসি ও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে অনুরোধ করা হয়। একই সঙ্গে পেট্রলের মানসংক্রান্ত আগের আইন আরো দুই বছর বহাল রাখার জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ করা হয়। সুপারিশের ভিত্তিতে গত বছরের ১২ নভেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয় বিএসটিআইকে চিঠি দেয়। ওই পরিপ্রেক্ষিতে বিএসটিআই মান নির্ধারণের নতুন কমিটি পেট্রলের আরওএন ৮০-তে রাখার সুপারিশ করে। আর পিআরএবি আবেদনের বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণের আগেই বিগত ১৭ ফেব্রুয়ারি পেট্রলের মান আরওএন ৮৯ কার্যকর হয়। তারপর থেকে সেই মান অনুযায়ী রিফাইনারিগুলো পেট্রল সরবরাহে হিমশিম খাচ্ছিল। কোনোভাবেই পেট্রলের মান আরওএন ৮৯-এ নিতে না পারায় বিপিসি রিফাইনারি থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দেয়।
অন্যদিকে পেট্রলের মান কমানো-সংক্রান্ত চিঠির বিষয়ে বিএসটিআই পরিচালক (মান) নিলুফা হক জানান, বিএসটিআইএর পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছি। বিএসটিআইএর কাছে সুপারিশ চাওয়া হয়েছে এবং তা দেয়া হয়েছে।
কী কারণে পেট্রলের মান কমানোর সুপারিশ করা হলো প্রসঙ্গে বিএসটিআই মান নির্ধারণ বিষয়ক কমিটির প্রধান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম জানান, মূলত পেট্রলের মান বাড়ানোর কথা বলা হলেও রিফাইনারিগুলো ওই মান অনুযায়ী তেল সরবরাহে সক্ষম নয়। তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হলে আরো সময় প্রয়োজন। যে কারণে তাদের সময় দিতে আগের মান পুনর্বহাল রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।