সাম্প্রদায়িকতার ধুয়া তুলে প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানী সরকার বাংলা ভাষাকে নির্মুল করতে চেয়েছিল। তাদের সে অযৌক্তিক দাবীকে প্রত্যাক্ষান করে বাংলার দামান ছেলেরা তাদের বুকের তৃপ্ত রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়েছিল, বিসর্জন দিয়েছিল প্রাণ। রক্ষা করেছে মাতৃভাষা বাংলার সম্মান। ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে বিশে^ সৃষ্টি করেছে এক অনন্য উদাহরণ। সেই বাংলা ভাষা আজ বিশ^জয় করে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে আপন মহিমায়। আজ শুধু বাংলাদেশের ১৬ কোটি বাঙ্গালি নয় ভারতের পশ্চিম বঙ্গ সহ আসাম, ত্রিপুরা, ঝারখন্ড, উড়িশা, আন্দামান-নিকোরব, ধানবাদ, মানভূম, সাওতাল পরগনা প্রভৃতি এলাকায় বাংলা ভাষার প্রচলন রয়েছে। এর বাইরে নেপাল, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, গনচীন সিঙ্গাপুর, মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইতালি ইত্যাদি দেশে বিপুল সংখ্যক বাংলাভাষী অভিবাসী ও প্রবাসী রয়েছেন। পরিসংখ্যান মতে বিশ^জুড়ে মোট বাংলাভাষীর সংখ্যা ২৬ কোটি ৫০ লাখের কিছু বেশি। তবে ভাষা গবেষকরা বলছেন, বিশে^ ২৮ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলেন। তবে ক্রমিক বিচারে সারা বিশে^র ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলার অবস্থান পঞ্চম।
মুলত: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল বিজয়ের মাধ্যমে ১৯১৩ সালে প্রথম বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এসেছে। এরপর শত বছরেরও অধিক কাল বাংলা ভাষা নিয়ে বিশে^ তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। তবে বাংলা ভাষার দাবীতে প্রাণ বিসর্জন দেয়া ২১ ফেব্রুয়ারী সেই দিবসকে স্বরণীয় করে রাখতে ইউনেসকো ওই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দিলে গোটা বিশে^ বাংলা ভাষার মর্যাদা বেড়ে বিশ^বাসীর দৃষ্টিতে আবারো আসে বাংলা ভাষা। আজ শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা বিশ^ই একুশে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করছে।
বিশ^ ব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সাধারন মানুষের মাধ্যমে বাংলা ভাষা পাচ্ছে বৈশি^ক ব্যাপ্তি। পরিবর্তিত বিশ^ পরিস্থিতির কারনে বাংলাভাষী মানুষ আজ ছড়িয়ে গেছেন বিশে^ বিভিন্ন দেশে, তাদের মধ্যে কায়িক শ্রমের মাধ্যমে বিদেশী শ্রমবাজার এবং দেশি অর্থনীতির হাল ধরা মানুষ যেমন আছেন, তেমনি ব্যবসায়ীক প্রয়োজন, উচ্চ শিক্ষা কিংবা চাকুরি সহ বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ডে নিযুক্ত প্রবাসী বাংলা ভাষীদের সংখ্যাও ক্রমে বাড়ছে। আর তাদের অনেকেই দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষাকে তুলে ধরতে প্রবাসে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলা ভাষাভাষি বিভিন্ন বিদ্যালয়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্য কোথায় নেই এই বিদ্যালয় ? ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ও কানাডা থেকে বাংলা ভাষায় বর্তমানে একাধিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, টিভি-বেতার চ্যানেলে বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। এসব বাংলা ভাষা ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিক অনুষ্ঠান গুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলা ভাষাকে বিদেশের মাঠিতে নতুন ভাবে তুলে ধরা। বই মেলা, সংঙ্গীত, কবিতা সন্ধ্যা, নৃত্যনাট্য সব কিছুতেই বাংলা ভাষার জয়ধ্বনি আজ শোনা যাচ্ছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী নিজ নিজ অভিবাসী দেশে এখন সংবাদ মাধ্যম চালু করেছেন।
বিশে^ বিভিন্ন দেশ থেকে অন লাইলে বাংলা পত্রিকা পাওয়া যাচ্ছে। এখন আর শুধু বাংলাদেশ বা ভারতেই নয়, গোটা বিশ^ থেকেই বাংলা ভাষায় পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে বা অনলাইলে যুক্ত হচ্ছে। শুধু তাই নয় বিশে^র প্রায় ১০টি দেশের রাষ্ট্রিয় বেতারে বাংলা ভাষার আলাদা চ্যানেল রয়েছে। এছাড়াও আরো ১০টি রেডিওতে বাংলা ভাষার আলাদা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে ১১টি এবং যুক্তরাজ্যে ছ’টি বাংলাদেশী মালিকানা বাংলা চ্যানেল আছে, আছে কানাডায়ও। যুক্তরাজ্য থেকে প্রয় এক ডজন বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ হয়। বেতার বাংলা নামে সেখানে একটি রেডিও স্টেশনও রয়েছে। এর বাইরে বেশ কিছু পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা বের হয় সেখান থেকে। ওদিকে ইউরোপের ইতালি থেকে বর্তমান অর্ধ-ডজন পত্রিকা প্রকাশ হয়। আর রোম ও ভেনাস থেকে তিনটি রেডিও স্টেশন পরিচালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগ থেকেই লন্ডনের সোয়াসে প্রাচ্যবিদ্যা ও ভাষা চর্চা বিভাগে চলছে বাংলা ভাষার চর্চা ও গবেষণা। যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু বিশ^বিদ্যায় এবং এশিয় গবেষনা কেন্দ্রে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। যার মধ্যে নিউইয়ক, ইথাকা, শিকাগো, মিনেসোটা, ফ্লোরিডা, মেরিল্যান্ড, ক্যালিফোরনিয়া, ভার্জিনিয়ার নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতার পর থেকে গত শতকের আশির দশক পর্যন্ত বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়া। মষ্কোর প্রগতি প্রকাশনের উদ্যোগে রুশভাষার ধ্রুপদি বই গুলোর বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হতো এবং নামমাত্র মূল্যে সেগুলো বিক্রি হতো। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর এ উদ্যোগ থেমে গেছে। তবে বিশে^র দেশে দেশে বাংলা ভাষা শিক্ষাদান সহ গবেষনার পরিধি বাড়ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনান্দ দাস, লালন সাই, চর্যাপদ এবং মধ্যযুগীয় সাহিত্য নিয়ে গবেষনা করছেন বিদেশী ভাষা গবেষকরা। জাপান, চীন, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়ও বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে জাপান ও গনচীন এগিয়ে আছে। জাপানে প্রায় ৭০ বছর আগে কাজুয়ো আজুমা রবীন্দ্র প্রেম থেকে বাংলা ভাষার চর্চা শুরু করেন। গন চীনের রেডিও পিকিং থেকে দীর্ঘদিন থেকে বাংলায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে। বেশ কিছু বাংলা অনুবাদ কর্মও প্রকাশিত হয়েছে গনচীন থেকে। বেশ কিছুদিন থেকে সেখানে বাংলা ভাষা নিয়ে ব্যাপক কাজ হচ্ছে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বাংলা থেকে চীনা ভাষায় অনুবাদের কাজ চলছে। তারা বাংলা ভাষা নিয়ে রীতিমতো প্রকল্প প্রনয়ন করে কাজ করছেন। বাংলাদেশের সাথে গনচীনের ব্যবসায়ীক সম্পর্ক বৃদ্ধির সাথে সাথে চীনাদের মাঝে বাংলা ভাষা শেখার ব্যাপারে আগ্রহ বেড়েছে। সেখানে একাধিক বিশ^দ্যিালয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষনা শুরু হয়েছে। সাথে বাংলা ভাষার কোর্সও চালু হয়েছে বেশ কয়েকটি বিশ^বিদ্যালয়ে। সম্প্রতি বেইজিং বিশ^বিদ্যালয় ও রেইসিং ইউনিভারসিটি অফ ফরেন স্ট্রাডিজ নামে বিশ^বিদ্যালয় দু’টিতে বাংলা ভাষা কোর্স চালু হয়েছে। এমনকি সেখানে বাংলা বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু রয়েছে। সেখানে চীনা ছাত্র-ছাত্রীরা অধ্যায়ন করছেন। আর বাংলা শিক্ষা দান করছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটউটের প্রাক্তন বাংলা ভাষার চীনা শিক্ষার্থীরা।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়া, পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্রে বাংলা ভাষার চর্চা ও গবেষণা চলছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিদ্যালয় ও বিশ^বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশে^র নানা দেশে বাংলা শেখার পর্যাপ্ত সুযোগ ও চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে বাংলার চাহিদা বাড়ছে। অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয় সে দেশের বিদ্যালয় গুলোর যে সব এশীয় ভাষা শেখার অনুমতি দিয়েছে এবং যে সব ভাষা শেখার গুরুত্ব দিয়েছে তার মধ্যে বাংলার অবস্থান তৃতীয়। আর বাংলাদেশের সীমান থেকে বহু দূরে অনেকের কাছেই অপরিচিত আফ্রিকার একটি দেশের প্রধান দাপ্তরিক ভাষা বাংলা। দেশটির নাম সিয়েরালিওন।
বাংলা ভাষার এ বিশ^ জয় আমাদের অনুপ্রানীত করে। সাথে শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত হয় বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে শহীদ হওয়া ব্যক্তিত্বদের প্রতি।