চরাঞ্চল গুলোতে বিদ্যুৎ পৌছায় লালমনিরহাটের তিস্তা নদীর বিস্তীর্ণ এলাকার চরজুড়ে এখন চারিদিকে ফলেছে ফসল আর ফসল। চরে এখন তাকালেই দেখা যায় সবুজের সমারোহ। শীতকালীন বিভিন্ন সবজি ছাড়াও বিভিন্ন ফসলে ভরে উঠেছে চরাঞ্চল। জেলার পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারি ও সদর এই ৫ উপজেলায় চরের বেলে দোআঁশ মাটিতে চাষিরা স্বল্প খরচে ফলিয়েছেন সোনার ফসল।
চরাঞ্চলে সবজির প্রাচুর্য দেখে যে কারও চোখ জুড়াবে। সেই সাথে চোখ জুড়াচ্ছে চাষিদেরও। তবে দামে মন ভরছে না তাদের। শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধা এবং কৃষি উপকরনের দাম বেশি হওয়ার কারণে চাষিদের লাভ হচ্ছে কম।
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতীবন্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারীর উপজেলায় তিস্তার চরে জেগে ওঠা জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৭৯ হেক্টর। এরমধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ ১১ হাজার ৯৪৮ হেক্টর। এর মধ্যে ৬৬৫ হেক্টর চরের জমিতে সবজি চাষ হয়েছে।
কালিগঞ্জ উপজেলার চর রুদ্রেশ্বরের চরাঞ্চলের জমিতে এখন টমেটো, বাঁধাকপি, বেগুন, শিম, লাউ, পেঁপেসহ বিভিন্ন তরতাজা সবজিতে ভরে উঠেছে মাঠ। এ চরে পিয়াজ, রসুন, মাসকলাইসহ আরও নানা ফসল চাষ করেছেন চাষিরা।
কৃষকরা জানিয়েছেন, বেলে দোআঁশ মাটিতে সার দেয়ার প্রয়োজন হয় না। পোকামাকড়েরও আক্রমণ কম। তাই খুব একটা কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। শুধু পানি পেলেই চরে সব ফসলের আবাদ ভালো হয়। কিন্তু শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে তারা সবজির দাম পান কম। এখন চরে বিদ্যুৎ আসার কারণে সেচের যোগানও হচ্ছে।
চর শৈলমারি গ্রামের চাষি আফজাল হোসেন বলেন, নদী বড় থাকলে নৌকায় তাদের যোগাযোগ সহজ হয়। কিন্তু ওই সময় পানি ঢুকার কারণে তাদের চাষের জমি কমে যায়। আবার পানি নেমে গেলে যে পলি পড়ে তাতে সবজির চাষ ভালো হয়। কিন্তু তখন নৌপথ কমে গিয়ে বেড়ে যায় পায়ে হাঁটার পথ। এই দুর্গম চর থেকে তাদের সবজি ওপারের বাজারে নিতে নিতেই তাজা সবজি আর তাজা থাকে না। তখন পাইকারি ক্রেতারা দাম কম দেন।
আবার অনেক ব্যবসায়ী চরে সবজি কিনতে আসেন। কিন্তু বিশাল চর আর নদী পাড়ি দিয়ে সবজি নিয়ে যেতে হবে বলে তাদের কম দাম দেয়া হয়। এতে তাদের ক্ষতি না হলেও লাভের পরিমাণ কমে যায়।
একই এলাকার টমেটো চাষি নুর আলী বলেন, নদীর ওপারে যদি টমেটোর কেজি ১০০ টাকা হয়, তাহলে এপারে ৫০ টাকা। এটাই নদীর চরের এপার-ওপার জমিতে উৎপাদিত ফসলের দামের এমন পার্থক্য। তবে গ্রীষ্মকালে পানি কমে নদী ছোট হয়ে আসে। তখন সবজি গরু-মহিষের গাড়ি অথবা ট্রলিতে করে নিয়ে চর পাড়ি দিতে হয়।
কিন্তু চরের মাঝে যদি আবার ছোট নদী থাকে তাহলে ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়। এসব ভোগান্তির কারণেই তারা ভালো সবজি উৎপাদন করলেও ভালো দাম পান না।
কালিগঞ্জের কাকিনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল হক বলেন, চরের সবজি খুব সুস্বাদু। নদীর ওপারের সবজি আর এপারের সবজির স্বাদের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। চরাঞ্চলের সবজির স্বাদ ভালো হওয়ার কারণ এখানে জমিতে সার-কীটনাশকের প্রয়োজন হয় না। শুধু পানি পেলেই চরে খুব ভালো সবজি উৎপাদন হয়। কিন্তু এত ভালো সবজি উৎপাদন করেও চাষিরা ভালো মূল্য পাচ্ছেন না।
চাষিরা বলেন, তিস্তা নদীর পাড় থেকে চরের গ্রাম পর্যন্ত যদি পাকা রাস্তা নির্মাণ করা যায় তাহলে চাষিদের কষ্ট অনেক কমে যাবে। চাষিরা অন্তত সহজে নদীপাড় পর্যন্ত তাদের ফসল নির্বিঘেœ নিয়ে যেতে পারবেন। এদিকে তিস্তা নদীতে চর জেগে ওঠা এসব জমিতে এখন সারাবছর ধরে উৎপাদন করা হচ্ছে সবজিসহ বিভিন্ন ফসল। যা স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাজারজাত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
এ অঞ্চলের লোকজন জানান, একসময় চরাঞ্চলের জমিতে শুধু ধান, গম আর ভুট্টা চাষ হতো। কিন্তু এখন সেই জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে, পেয়ারা বাগান, কলা বাগানসহ বিভিন্ন রকম সবজি ও ফল চাষ। বিশেষ করে শীত মৌসুমে এখন ভরেছে আগাম সবজিতে। কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষাবাদ করে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করছেন।
সরেজমিনে চরাঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, আদিতমারী উপজেলার নদী তীরবর্তী মহিষখোচা ইউনিয়নের বালাপাড়া, কুটিরপাড়, কালমাটি, আনন্দবাজার, কালিগঞ্জের রুদ্রেশ্বর, কাকিনা, মহিষামুরি, ইশোরকুল এসব চরে এবার প্রচুর পরিমানে আলু চাষ হয়েছে। এছাড়াও বেগুন, টমেটো, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শিম, করলা, পুঁইশাক ও লালশাকসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ হচ্ছে। চাষ হচ্ছে পিয়াজ ও রসুনও। কৃষকরা বলছেন, ইতোমধ্যে বাজারে কিছু পিয়াজ উঠলেও খুব শীঘ্রই পরোদমে নতুন পিয়াজ এবং রসুন উঠবে। চর গুলোতে এসব আবাদের পাশাপাশি চাষ হতে চলেছে গম, ছোলা, ভুট্টা, মসুর, সরিষা ও বাদামের।
কুটিরপাড় গ্রামের আসাদুল জানান, তিনি ৫ বিঘা জমিতে শীতকালীন শাকসবজি হিসেবে কপি ও বেগুন চাষ করছেন। চরাঞ্চলের এসব এলাকায় বিদ্যুৎ আসার কারণে সেচের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে মর্টার।
লালমনিহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামীম আশরাফ বলেন, চরের মাটিতে যেকোন ফসলের আবাদ অত্যন্ত ভালো হয়ে থাকে। প্রতিবছর বন্যায় জমি তলিয়ে যাওয়ার পর নতুন করে পলি জমার কারণে চাষাবাদ ভালো হয়। এ বছর দাম কিছুটা ভালো পাওয়া যাচ্ছে।