ধরলার চর মাধবরাম। গত বন্যায় এই গ্রামের পুরোটাই ডুবে ছিলো থৈ থৈ পানিতে। উজানে জগমোহনের চরে ছিলো প্রলয়ঙ্করী ভাঙন। তাই বালু পড়ে অনাবাদী হয়েছে এই চরের শত শত একর জমি। এবার সেই বালুকাময় জমিতে সূর্যমুখীর হাসি দেখে বুক ভরে গেছে কৃষকের। সারি সারি হৃষ্ট পুষ্ট সূর্যমুখী গাছের ডগায় বড় বড় আকারের ফুল। যেন দিগন্ত জুড়ে হলুদের উৎসব।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ আশা করছে, কুড়িগ্রামের চরভূমিতে সুর্যমুখী চাষ সম্প্রসারণ করে চরের কৃষকের ভাগ্য বদলে যাবে। সেই সঙ্গে বদলে যাবে অনুন্নত এই জেলার অর্থনৈতিক চিত্র।
কৃষি বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, কুড়িগ্রামে রয়েছে ১৬টি নদ-নদী আর ৫ শতাধিক চর। এই চরের পতিত জমিতে সূর্যমূখী চাষ করে সাফল্য পাচ্ছে চাষীরা। বাড়ছে আবাদ। এতে করে একদিকে যেমন আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে পতিত অনাবাদি জমিকে কাজে লাগিয়ে লাভবান হচ্ছে কৃষক। গত বছর জেলায় ২০ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখীর আবাদ হলেও এবার আবাদ হয়েছে ২০০ হেক্টর জমিতে। প্রতি হেক্টরে ২ মে.টন সূর্যমূখী তেলবীজ উৎপাদন হয়। বর্তমানে প্রতি কেজি বীজের দাম ৮০ টাকা। সে হিসেবে এবার জেলায় কমপক্ষে ৩২ কোটি টাকার সুর্যমুখীর তেলবীজ বিক্রি হবে। দাম বাড়লে এই অঙ্ক আরো বাড়বে।
কৃষকরা জানান, প্রতি হেক্টর জমিতে উৎপাদন খরচ পড়ে ৫০-৬০ হাজার টাকা। আর বিক্রি হয় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার তৈলবীজ। নভেম্বরের মাঝামাঝি বীজ বোনার পর মার্চের দিকে ফসল ঘরে ওঠে। তারা জানান, সূর্যমূখী থেকে পাখির খাবারের পাশাপাশি কোলস্টরেল মুক্ত তেল উৎপাদন করে ক্ষতিকর পাম ওয়েল ও সয়াবিন এর স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে রেহাই পাবেন ভোক্তারা। আর সুর্যমুখীর গাছে চাহিদা মিটছে জ¦ালানির। ইতোমধ্যে ভালো মার্কেটিং-এর সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় সূর্যমূখী চাষ করে হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখে।
কুড়িগ্রাম পুরাতন হাসপাতাল পাড়ার কৃষক আবু বক্কর সিদ্দিক সদর উপজেলার চর মাধবরামে গত দু’বছর ধরে চরের জমি বিঘা প্রতি ৫-৬ হাজার টাকায় লিজ নিয়ে সূর্যমূখির চাষ করেছেন। গত বছর ২১ বিঘা জমিতে আবাদ করে এক লাখ টাকা লাভ করেছেন। এবার ৫০ বিঘা জমিতে আবাদ করেছেন সূর্যমুখী। খরচ পড়েছে ৪ লাখ টাকা। প্রায় সব গাছে ফুল ধরেছে। ক্ষেতের অবস্থা দেখে এবং এবছর বাজার ভালো থাকায় উৎপাদন খরচের তিনগুণ টাকা লাভের আশা করছেন। তার সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে এলাকার অনেক কৃষক ঝুঁকে পড়েছেন সুর্যমুখী চাষের দিকে। এদের একজন লাল মিয়া। তিনি জানান, চরের জমিতে সূর্যমুখীর ভালো ফলন দেখে তারাও উপজেলা কৃষি অফিসের সহায়তায় চাষ করেছেন সুর্যমূখীর। ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলে বাণিজ্যিক ভিত্তিকে সুর্যমুখীর চাষ বাড়বে বলে জানান কৃষকরা।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো: জাকির হোসেন জানান, সদর উপজেলার ২০ একর জমিতে এবছর সূর্যমুখীর চাষ করেছেন চাষীরা। কৃষি বিভাগ থেকে তাদের বীজ সহায়তা দেয়া হয়েছে।
কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বন্যার পর চর এলাকার বালুকাময় অনেক জমি পতিত থাকে। ফসল চাষের চেষ্টা করে লাভবান না হয়ে উল্টো ক্ষতির মুখে পড়ে চাষীরা। এসব জমিতে সূর্যমুখী চাষ করে ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে। তাই আগামীতে জেলার চরাঞ্চলের পতিত জমি গুলোকে চাষের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে কৃষি বিভাগের।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো: মঞ্জুরুল হক জানান, জেলার ৪৬ হাজার চরভূমির বেশিরভাগে সুর্যমুখী চাষের অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। জেলার দারিদ্র্য বিমোচনে সূর্যমুখী চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক খন্দকার আবদুল ওয়াহেদ জানান, রংপুর অঞ্চলে এবার ১ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে সুর্যমুখীর চাষ হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে চারগুণ বেশি। বর্তমানে দেশে ভোজ্যতেলের দাম অনেক বেড়ে গেছে। সরিষা চাষে সময় মেলানো কঠিন হয়, ফলনও কম। সরিষার চেয়ে সুর্যমুখীর বাজারও ভালো। ভালো মাকের্টিং করতে পারলে এবং উদ্যোক্তরা তেল উৎপাদনে এগিয়ে আসলে সূর্যমুখী তেল দিয়েই দেশের ভোজ্যতেলের চাহিদা অনেকাংশে মেটানো সম্ভব।