সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে ইশারা ইংগিতের ভাষা বিলুপ্ত হয়ে কথ্য ভাষার প্রচলন হয়েছে। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানবসভ্যতার পাশাপাশি স্বত:স্ফূর্ত ভাবেই ভাষারও বিবর্তন ঘটছে। সময় অবস্থান ও ভৌগলিক কারণে জন্ম হয়েছে নানা ভাষা। সারা বিশ্বে তাই আজ একেক অঞ্চলের মাতৃভাষা এক একটি, কোনোটির সাথে কোনটির মিল নেই। যে যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ মাতৃভাষাকে শ্রেষ্ঠতর মনে করেন। ভাষার সংখ্যা নিয়ে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান গবেষণা করেছেন। তবে ভাষা বিজ্ঞানীদের কাছে সামার ইন্সটিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকস (এস আই এন)’র গবেষণা সবচে বেশি গ্রহণযোগ্য। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এ আন্তর্জাতিক সংস্থা ২০০৯ সালে ভাষা নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে তারা বলছে, গোটা বিশ্বে ভাষার সংখ্যা ছ’হাজার ৯০৯টি। তবে ভাষা বিজ্ঞানীরা মনে করেন সারা বিশ্বে প্রায় সাত হাজার ভাষা রয়েছে। সত্যি বলতে কি আমরা অর্ধশত ভাষার নাম বলতে পারবো না। নাম না জানা এতো ভাষার মধ্যে অনেক ভাষাই এখন বিলুপ্ত প্রায়ই, অনেক ভাষা লুকিয়ে রয়েছে আবার অনেক ভাষা বদলাতে বদলাতে অন্য রকম হয়ে গেছে। লক্ষণীয় বিষয় এমন ভাষাও বিশ্বে রয়েছে যে ভাষায় কথা বলেন মাত্র গুটি কয়েক মানুষ। ধরা যেতে পারে পাপুয়া নিউগিনির কথা। সেখানে জনসংখ্যা ৪০ লাখেরও কম। অথচ সেখানে অজানা ভাষা রয়েছে ৮৩২টি।
আমাদের প্রতিবেশী ভারতের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, ১৯৬১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী এক হাজার ৬৫২টি ভাষা ও আঞ্চলিক ভাষাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। যদিও তা পরে কমিয়ে দেয়া হয়েছে। তারপরও বর্তমানে সংবিধান স্বীকৃত ভাষা হলো ২২টি। ভারতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যাক লোক হিন্দিতে কথা বলেন, এর পর বলেন বাংলায়। যদিও শতকের হিসেবে দু’ভাষার ব্যবধান অনেক, একটি ৪১ শতাংশ, অন্যটি ৮.১ শতাংশ। তারপরও বাঙালি হিসেবে মনের অজান্তে পুলকিত হই আর বলি তাও কম কিসে? সুপ্রিয় পাঠক! আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন, বাংলাই হোলো বিশ্বের এক এবং একমাত্র ভাষা যে ভাষায় রচিত হয়েছে তিনটি ভিন্ন রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত। ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার জাতীয় সংগীত রচিত এই বাংলা ভাষাতেই।
ভাষার মান রাখতে আন্দোলন সংগ্রাম করে রক্ত ও প্রাণ বিসর্জন দানকারী বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের কাছে বাংলা শুধু একটি ভাষা নয়, বাংলা জুড়ে আছে আমাদের আবেগ, অনুভূতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংগ্রাম। তারপর ইউনেসকো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে বাংলা ভাষার মান বিশ্ব জুড়ে বাড়িয়ে দিয়েছে। বাঙালিকে করেছে গর্বিত। আর সেই বাংলাদেশে প্রচলিত ভাষার সংখ্যা ৪২টি। ভাষা নিয়ে গবেষণা এবং অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান ইথনোলগ এর সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যানুসারে এর মাঝে অনেক ভাষা অক্ষরহীন, তাদের কোন বর্ণমালা নেই। মুখে মুখে সে ভাষাগুলো বেঁচে আছে। আবার অনেক গুলো ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শুনতে বিস্ময়কর মনে হলেও তিন পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাঝে মাত্র ২৫জন ব্যক্তি বেংমিটচা ভাষায় কথা বলেন।
বিশ্বে সব চেয়ে বেশি মানুষ ইংরেজীতে কথা বলেন যখন দু’টি মানুষের মাতৃভাষা ভিন্ন হয় তখন তারা সাধারণত: ইংরেজীতেই পরস্পরের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের হিসেবে বিশ্বে এখন ইংরেজীতে কথা বলেন ১৫০ কোটি মানুষ। তবে এর মধ্যে ৪০ কোটিরও কম মানুষের মাতৃভাষা এটি। কেমব্রীজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গণচীনের ৩ কোটি মানুষের ইংরেজী ভাষায় কিছুটা হলেও জ্ঞান আছে। আর ভারতে আছে আরো ২০ কোটি মানুষের। যক্তরাষ্ট্রের যত মানুষের মাতৃভাষা ইংরেজী। তার চেয়ে সম্ভবত: অনেক বেশি চীনা নাগরিকের দ্বিতীয় ভাষা এটি। যুক্তরাষ্ট্রের এক পঞ্চমাংশ মানুষ তাদের বাড়িতে ইংরেজী ছাড়া ভিন্ন একটি ভাষায় কথা বলেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা রকম ইংরেজী ভাষা চালু আছে। খোদ ইংল্যান্ডের সব মানুষ একই ধরনের ইংরেজীতে কথা বলেন না। যেমন ইংল্যান্ডের ঐতিহাসিক বন্দর নগরী স্পোর্টস সাউথে এখনো আঞ্চলিক ‘পম্পেই’ চালু আছে। এটি অন লাইনে তৈরি হওয়া নতুন ধরনের ইংরেজী ভাষা। আমেরিকানদের চ্যালেঞ্জ করে এখনো এটি টিকে আছে। ইংরেজী ভাষার জন্য চ্যালেঞ্জই কেবল এদিক থেকে নয়, বিপদ ঘটছে অন্যদিক থেকেও। এতো বেশি মানুষ ইংরেজীতে কথা বলেন, যে যার মত তাদের ভাষা ঢুকিয়ে মুল ইংরেজীতে হাই ব্রিড বা জগা খিচুড়ি ইংরেজী বানিয়ে ফেলেছেন। স্ট্যান্ডার্ড বা সত্যিকার ইংরেজী ভাষার কিছু কিছু অংশের সঙ্গে স্থানীয় ভাষা মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে এসব ভাষা। শুধু ভারতেই আপনি শুনতে পাবেন হিংলিশ (হিন্দি+ইংলিশ), বাংলিশ (বাংলা+ইংরেজী), এবং তাংলিশ (তামিল+ইংলিশ)। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক হিম্পানিক আমেরিকান তাদের মধ্যে ঐতিহ্য ধরে রাখতে চায়। তারা ইংরেজী এবং তাদের মা-বাবা বা তারও আগের প্রজন্মের অভিভাসি পিতামাথার ভাষা মিলিয়ে তৈরি করছেন এক নতুন ভাষা স্প্যাংলিশ।
সামগ্রীক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে, বলা যায় মুল ইংরেজী ভাষা এখন তার আবেদন হারাচ্ছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যে ইংরেজী চর্চা হচ্ছে তা মুল ইংরেজীর বিকৃতি। তাছাড়া কম্পিউটার অনুবাদ প্রযুক্তি এবং ভয়েজ রিকগনাইজেশন টেকনোজি বা কণ্ঠ সনাক্ত করন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে এখন নিজের ভাষায় কথা বলেই ভিন্ন ভাষার মানুষের সাথে কথা বলা সম্ভব। কাজেই বিশ্ব যোগাযোগের ভাষা হিসেবে ইংরেজীর দিন ফুরিয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, পরাশক্তি হিসেবে গন চীনের উত্থানের ফলে ইংরেজীর আধিপত্য একন চ্যালেঞ্জের মুখে। আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলের কোনো দেশে একজন কর্ম প্রত্যাশী তরুন ইংরেজী বা ম্যান্ডারিন চাইনিজ এ দু’ভাষার কোনটি শিখতে বেশি আগ্রহী হবে? ক্যারিয়ার বিবেচনায় ইংরেজী শিখে যুক্তরাষ্ট্র বা বৃটেনে গিয়ে কাজ খোঁজার চেয়ে তার কাছে ম্যান্ডারিন শিখে গনচীনে যাওয়া কিন্তু অনেক বেশি আকর্ষণীয়, তবে উগান্ডার সব মাধ্যমিক স্কুলেই লেখাপড়ার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজী জনপ্রিয়। অনেক বাবা-মা তো ইংরাজীতেই প্রথম ভাষা হিসেবে সেখান তাদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা দেন। এখনো বিশ্বের অনেক জায়গায়ই ইংরেজীর জয়জয়াকার। তবে শুধু আফ্রিকা নয়, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও চীনা ভাষা শেখাটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ২০১৫ সালের এক খবরে বলা হয়েছিলো সেখানে স্কুল পর্যায়ে ম্যান্ডারিন শিখছেন এমন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দু’বছরের মধ্যে দ্বিগুন হয়েছে। আর কলেজ পর্যায়ে তা দশ বছরে বেড়েছে পঞ্চাশ শতাংশ।
ইন্টারনেটের কারনে গোটা বিশ্বই এখন কম্পিউটার নির্ভর হয়ে উঠেছে। হাতের স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে এখন গোটা বিশ্বই হাতের মুঠোয়। ব্যক্তিগত যোগাযোগ, দাপ্তরিক, ব্যবসায়ীক যে কোনো গেযাযোগই এখন মুঠো ফোনের মাধ্যমে নিমিশেই করা সম্ভব। তাই অনুবাদ প্রযুক্তি বা কণ্ঠ সনাক্তকরন প্রযুক্তির কারনে ইংরেজী ভাষা বাদ দিয়ে নিজ নিজ ভাষায় যে কেউ তার প্রয়োজন সারতে পারেন। তাহলে আর কষ্ট করে কেন ইংরেজী ভাষা শিখাবেন? বাংলা ভাষার একজন কবি রামনীধি গুপ্তর একটি পংতি, ‘নানান দেশের নানা ভাষা, বিশ্বে স্বদেশী ভাষা, পুরে কি আশা? সবাই নিজ নিজ মাতৃ ভাষায় কথা বলতে পারছেন। তাই সবাই তাদের নিজ ভাষায় যোগাযোগ রক্ষা করবেন।