বিতর্কিত হলেও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা রয়েছে। সময়ের ব্যবধানে সে তালিকা রাজনৈতিক কারণে বিতর্কিত হলেও তালিকাটির নিরীখে মুক্তিযোদ্ধা এবং তার সন্তানদের নানা সুযোগ- সুবিধা দেয়া সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জাতির থিক্কৃত ও নিকৃষ্ট রাজাকার; আলবদর ও আল শামসের কোন গ্রহণ যোগ্য তালিকা নেই। ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত এসব মানুষ সময়ের ব্যবধানে আর্থিকভাবে ফুলে ফেপে তারা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে। শুধু তাই না, তারা নির্বাচনে জয়ী হয়ে পবিত্র সংসদের আসনে বসেছেন, মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে আমার অহংকারের লাল সবুজের পতাকা উড়িয়েছেন। লজ্জা-ঘৃণায় আমার বিবেক বারবার দংশন করলেও তারা বহাল তবিয়তে ধর্মের নামে রাজনীতির নেবাস পারে দম্ভ ভরে বলছেন, একাত্তরে তাদের ভূমিকা সঠিক ছিল। এজন্য তারা দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা চাইবেন না। তবে একদশক আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা রাষ্ট ক্ষমতায় এসে আন্তজার্তিক মানবাধীকার ট্রাইবুনালে তাদের হত্যা-খুন-ধর্ষণ-লুটতরাজের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেন এবং বিচারের রায় কার্যকর করেন। ঘাতক-দালাল নিমুল কমিটির দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সফল ভাবে আন্তজার্তিক মান দন্ডে শেষ হয়েছে, এবং কিছু বিচার কাজ চলমান রয়েছে। ঘাতক-দালাল নিমুল কমিটির মানবাধীকার বিরোধী অপরাধে বিচারের পাশাপাশি তার বরাবর রাজাকারের তালিকা প্রকাশের দাবি জানিয়ে আসছে। ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এ বি এম তাজুল ইসলাম সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন, রাজাকারের কোনো তালিকা সরকারের কাছে নেই। ১৯৭২ সালে দালাল আইনে প্রায় ৫৫ হাজার ব্যাক্তিকে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু কিছু ব্যাক্তিকে (যেসব ব্যাক্তির বিরুদ্ধে ধর্ষণ, খুন,অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ গুরুতর অভিযোগ ছিল না) সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে খুলনা আনসার হেডকোয়াটার্সে পাওয়া তালিকায় ৩০ হাজারের বেশি রাজাকারের তথ্য মিলেছে। সে তালিকা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দালালী করেছিলো, তাদের একটি গেজেট সে সময় প্রকাশ করা হয়েছিলো। ১৯৭২ সালে তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইবুনালে মামলাও হয়েছিলো। ১৯৭০ সালের উপ-নির্বাচনে যেসব ব্যাক্তিকে এমপিএ বা এমএলএ নির্বাচিত ঘোষনা করা হয়েছিল তাদেরও সেই গেজেটের রাজাকার বলা হয়েছিল। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘটাকরে ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ জনের নাম উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় রাজাকারের একটি তালিকা প্রকাশ করে। যা শুধু সমালোচিতই হয়নি রীতিমতো বিতর্কের ঝড় তোলে। ওই তালিকায় অনেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের অনেক নেতার নাম প্রকাশ পায়। অবশ্য এ কথা ঠিক মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকেই পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সাথে যোগাযোগ রাখলেও মুক্তিযোদ্ধাদের নানা খবর দিয়ে আশ্রয় দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়েছেন। তাদের অনেকের নামে সে সময় দানাল আইনে থানায় মামলাও হয়। ফলে ১৫ই ডিসেম্বর প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় তাদের নাম উঠে এসেছেন। বিষয়টি মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে সব মহলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়,আন্দোলন- সংগ্রামও শুরু হয়ে যায়। বিব্রত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ওই তালিকা স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন।ফলে সে তালিকা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েভ সাইড থেকে প্রত্যাহার করা হয়। বলা হয়েছিলো, ২০২০ সালের স্বাধীনতা দিবসের আগেই নতুন রাজাকারের তালিকায় প্রকাশ করা হবে। কিন্তু না, সে তালিকা জাতি পায়নি। বরং প্রশ্ন উঠেছে এ জাতীয় তালিকা প্রকাশের কোন এমতিয়ার সরকারের নাই। তবে সরকার বসে নেই। শেষ পর্যন্ত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল(জামুকা) আইন সংশোধন করে সে সুযোগ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। সাবেকমন্ত্রী শাজাহান খান এমপির নেতৃত্বে একটি উপকমিটিও গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি রাজাকারের তালিকায় নাম সংগ্রহের প্রক্রিয়া ও প্রকাশের বিষয়টি নির্বাচন করবে। সেই নিরীখে এ কমিটির সুপারিশেই জামুকা আইন সংশোধন করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত সংশোধনি ইতোমধ্যে মন্ত্রী পরিষদ অনুমোদন করেছে। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং নিয়ে সেটি বিজয় দিবসের আগে সংসদ উপস্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। রাজাকারের তালিকা প্রকাশের সব উদ্যোগ থেমে গেছে।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ খ ম মোজাম্মেল হকের দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে তিনি বলেন, সংসদের আগামী অধিবেশন এটি বিল আকারে উপস্থাপন করা হতে পারে। আগামী তিন মাসের মধ্যে এ অধিবেশন শুরু হবে। আইন পাশ না হওয়া পর্যন্ত রাজাকারের তালিকা প্রকাশের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়া সম্ভব নয়। তবে আগামী ২৬মার্চে স্বাধীনতা দিবসে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। তিনি রাজাকারের তালিকা প্রনয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বলেন, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় রাজাকার আলবদর আল শামস শান্তি কমিটির যেসব নথি থানা ও জেলা কালেষ্টয়েটে ছিল, সেসব নথির অনেক গুলোই সুকৌশলে সরিয়ে ফেলেছে। তাই পুরো তালিকা পাওয়া কঠিন নয় হয়ে পড়েছে। সে সময় ১৯ জেলার রেকর্ড রুমে যে সব দালিলিক প্রমান পত্র ছিল, সেগুলো চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু বলা হচ্ছে সেগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। তবে এসব তালিকা খুজেছে সরকারের একাধিক সংস্থা। তবে একথা তো ঠিক যে বা যারা সব দালিলিক প্রমান সরিয়েছেন, তারা তা সংরক্ষন করার জন্য করেননি।বরং তা ধবংস করার জন্যেই করেছে। তাই সামগ্রীক অবস্থা বিবেচনা করা যায়, পূনাঙ্গ এবং সঠিক রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করা খুবই জটিল এবং কঠিন রাজনৈতিক সিন্ধান্ত । স্বাধীনতার অর্থশতাব্দি পরে এখন অধিকাংশ রাজাকার আর বেঁচে নেই। ক্ষেত্রে বিশেষ তাদের সন্তান ও আতœীয়-স্বজন আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে বেশ শক্তিশালী অবস্থান ও তৈরি করে নিয়েছেন। আগামীতে রাজাকারর যে তালিকা জাতি পাবে, তা কোনো ভাবেই প্রশ্নাতিত নয়। নয় পুনাঙ্গ। কারন সে তালিকা সত্যায়নের জন্য সেই সময়ের মুক্তিযুদ্ধেও পক্ষে লোকজনও মারা গেছে।