১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এগিয়ে চলা দেশের স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর এসে আমাদের প্রত্যাশা বাংলায় লিখতে হবে সাইনবোর্ড বিলবোর্ড ব্যানার। কিন্তু বাস্তবতা হলো- এই প্রত্যাশার মুখ আমরা দেখতে পারছি না। কেন পারছি না? কারণ একটাই- আমরা রাজনীতিদের অপরাধ-দুর্নীতিতে পরাস্ত হচ্ছি প্রতিনিয়ত। বাংলা ভাষা আন্দোলন থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত হলেও বিজয়ের লাল সবুজ পতাকা হাতে পেয়েও আমরা রাজনীতিকদের রাজনৈতিক কালোর জন্য ভালোর পথে হাঁটতে পারছি না, পারছি না আলোর পথে চলতে।
ভাষা আন্দোলনের ভাষা শহীদদের প্রতি নূন্যতম শ্রদ্ধা থাকলেও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা সহ সারাদেশে ৬৪ জেলা শহরে গড়ে ২২ ভাগ ইংরেজী সাইনবোর্ড দেখতে হতো না। অবশ্য শহীদ সালাম-বরকতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারী একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় বিভিন্ন দৈনিকে। সেখানে সেই সংবাদ-এর কথাগুলো ছিলো এমন- ‘আগামী সাত দিনের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) এখতিয়ারাধীন সব প্রতিষ্ঠানের নামফলক, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড ও ব্যানার ইত্যাদি বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, বিদেশি সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে এ আদেশ প্রযোজ্য নয়।
২৮ জানুয়ারি ২০১৮ রোববার ডিএনসিসির এক গণবিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। উল্লেখ্য, হাইকোর্ট বিভাগের ১৬৯৬/২০১৪ নম্বর রিট পিটিশনের আদেশ অনুযায়ী ডিএনসিসি’র এখতিয়ারাধীন সব প্রতিষ্ঠানের নামফলক, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ইত্যাদি বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ডিএনসিসি’র গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় বিষয়টি হাইকোর্ট বিভাগ থেকে বাধ্যতামূলক হলেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের নামফলক, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ইত্যাদি ইংরেজি ও অন্যান্য বিদেশি ভাষায় লেখা হয়েছে। এমতাবস্থায় ডিএনসিসির এখতিয়ারাধীন এলাকার যাবতীয় প্রতিষ্ঠান মালিকদের স্ব-উদ্যোগে সাইনবোর্ড অপসারণ করে আগামী ৭ দিনের মধ্যে বাংলায় লিখে প্রতিস্থাপন করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।’
সেই ৭ দিন গিয়ে ৭০ দিন, ৭০০ দিন পার হয়ে গেলেও বাংলায় সাইনবোর্ড হওয়া তো দূরের কথা প্রতিনিয়ত কর্পোরেট হাউজগুলোর সাইনবোর্ড লাগছে ইংলিশে, আরবীতে এমনকি হিন্দিতেও। সঠিক ইতিহাস, সঠিকভাবে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদেরকে না জানানোর কারণে তারা ভুলে যেতে বসেছে- একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ মানে মায়ের ভাষা। একুশ মানে রক্তবীজ। একুশ মানে ভালোবাসা। একুশ মানে স্বাধীনতা। একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তবীজ থেকে অঙ্কুরিত হয়েছিল বাঙালি জাতির বোধিবৃক্ষ। ঘুমন্ত বাঙালি জেগে উঠেছিল। আত্মপরিচয় খুঁজে পেয়েছিল। মোগল-পাঠান-ইংরেজ আর পাকিস্তানি শাসনের শোষণভাঙার প্রত্যয়ে দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করেছিল। বায়ান্নর পরিণতিই একাত্তর। বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত একুশে পালন করত বাংলার গণমানুষ। সরকার কখনো বাধাদানকারী, কখনো নীরব দর্শক। কোনো আইন পাস হয়নি, সরকারি নির্দেশ জারি হয়নি, বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়নি। বোধিবৃক্ষের অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে বাংলার গ্রামেগঞ্জে রাতারাতি গড়ে উঠেছিল অসংখ্য শহীদ মিনার। একুশ মানে স্বাধীনতা। আর একুশের প্রতীক হলো শহীদ মিনার। তাই একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালরাতে হানাদার বাহিনী শহীদ মিনার আক্রমণ করেছিল। নিষ্প্রাণ ইট-সুরকিতে তৈরি শহীদ মিনারে প্রতিফলিত হয়েছিল বাঙালি জাতির প্রাণ।
২০০৫ সাল, আমার ছাত্র জীবনের কথা। তখন আমি বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ছাত্র অধিকার আন্দোলন জোটের সাধারণ সম্পাদক-এর দায়িত্ব পালন করছিলাম। সেই সময়ে আমার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাহিত্য-সংস্কৃতিপ্রাণ শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে অনুরোধ করেছিলাম, একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই যেন সব সাইনবোর্ড বাংলায় রূপান্তর করা হয়। ছাত্রদের হাতে অস্ত্র ছিল না, লাঠি ছিল না। আবেদনের ভাষায় হুমকি ছিল না। ভালোবাসা ছিল। ম্যাজিক ঘটে গেল। অল্প কয়েকটি দোকান ছাড়া সব দোকানপাটে বাংলা সাইনবোর্ড লাগানো হলো। একুশে ফেব্রুয়ারি রাতে আমাদের নিজেদের পয়সায় আলকাতরা কিনে ভিন্ন ভাষায় লেখা সাইনবোর্ডগুলোয় আলকাতরা মাখিয়ে দিয়েছিলাম। কাউকে ভয়ভীতি দেখানো হয়নি।
আজ ১৬ বছর পরও যখন দেখি- ঢাকার রাস্তার দুই পাশের সাইনবোর্ডগুলো অধিকাংশই বিজাতীয় ভাষায়। এমনকি বাংলা নামটিও ইংরেজি অক্ষরে লেখা। কথাবার্তায় ইংরেজির মিশেল না দিলে তো অভিজাত হওয়া যায় না। সংগ্রামের বাঙালি কি বিজয়ের শেষে ঘুমিয়ে পড়েছে? একুশের বোধিবৃক্ষ কি মরে গেছে? অনেকেই বলেন, বিশ্বায়নের কালো ছায়ায় বাঙালি নাকি স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে। জাপানি ও কোরিয়ানরা আগে ইংরেজি শিখত না। এখন ব্যবসার জন্য অনেকে শেখে। কিন্তু নিজেদের মধ্যকার কথাবার্তায় ইংরেজি বলে না। এমনকি রেস্তোরাঁর গ্রাহকদের সঙ্গেও ইংরেজি বলে না। জেনেও না জানার ভান করে। তারা জাতীয়তা সংহত করেছে। আমরা অর্জনের পর বিসর্জন দিচ্ছি। কিন্তু কেন?
কারণ হিসেবে বরাবরই আমি দেখি ক্ষয়ে যাওয়া আমাদের রাজনীতিকদের রাজনীতির নামে অপরাজনীতি। অথচ এই বাংলাদেশের বাঙালিরাই বায়ান্নর পর রক্ত দিয়ে অর্জিত মায়ের ভাষাকে অর্জনের মধ্য দিয়ে বলেছিলো- শহীদ মিনারকে বলেছিলাম বায়ান্নর বাংলা ভাষার প্রতীক। একাত্তরে এসে বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশ তথা বাঙালি জাতির হিমালয়সম প্রতীক। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে হত্যা করা হয়েছিল। বাঙালিত্বকে হত্যা করা হয়েছিল। কিছুসংখ্যক নাদান বানর প্রকৃতির বাঙালি এখন অযাচিত ভুল ইংরেজি বলে ‘জাতে’ উঠতে চায়। ডালভাত খাবার ভাঙাচোরা রেস্তোরাঁয় ইংরেজিতে ‘ফাইভ স্টার হোটেল’ সাইনবোর্ড টাঙিয়ে তৃপ্তি বোধ করে। গ্রাহকরা সাইনবোর্ডটি পড়তেও পারে না। বরং ইংরেজি লেখার একপাশে একটি মুরগি ও অন্য পাশে একটি খাসি বা গরু আঁকা দেখে বুঝতে পারে এটা হোটেল। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী? মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের দেশ বলে গর্ব করা হলেও চিত্তের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। বিত্ত কখনো চিত্তে অবস্থান করে না। চিত্তে থাকে ভালোবাসা। মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। বাঙালির চিত্তে অবস্থান গ্রহণ করে চিত্তকে জাগিয়ে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাকে হত্যার মাধ্যমে চিত্ত হত্যা করে আমরা অর্থনৈতিক উন্নতি তথা বিত্তের পেছনে কুকুরের মতো ঘুরছি। বিত্ত আহরণে দোষ নেই। কিন্তু বিত্ত নিয়ে অহংকার চিত্তের বোধিবৃক্ষকে হত্যা করে ফেলেছে। পাপের প্রায়শ্চিত্য করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। বায়ান্নর আত্মোপলব্ধির বৃক্ষকে জলসিঞ্চন করতে হবে। একাত্তরের আত্মপ্রত্যয় এবং অর্জনকে আবার হৃদয়ে স্থাপন করতে হবে। মনে রাখতে হবে- বাংলা আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা। এ ভাষা রক্ষার জন্য আমরা প্রাণ দিয়েছি। আমাদের স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা অর্জন। চলছে এখন সারাবিশ্বে মাতৃভাষার প্রচলন। বাংলা ভাষায় কথা বলে এখন গোটা বিশ্বে প্রায় ৩২ কোটি কিন্তু শুদ্ধ বানানে কত মানুষ এই ভাষা লিখতে পারে? বানান নিয়ে অনেক পন্ডিতের রয়েছে নানা পরামর্শও। সে কথা ভুলে গেলে চলবে না।
রক্ত দিয়ে অর্জিত বাংলা ভাষার দেশে সাহসের সাথে বলতে হবে- ভাষা হচ্ছে বহতা নদীর মত। এর মুখে বাঁধ দিলে তা হ্রদে পরিণত হয়, বহমানতা থাকে না। বাংলা ভাষা সংস্কৃতের গর্ভ থেকে উৎপত্তি হয়ে বহু বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। অথচ-ভাষা বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) বলেছিলেন তার সময়ে, ‘পাঁচ কোটি বাঙালির অধিকাংশই বানান ভুল করে।’ সেই আমল থেকে এখন পৃথিবীতে আমাদের সংখ্যা বেড়েছে অনেক। বর্তমানে আমরা পৃথিবীর মধ্যে এক বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী। আমাদের সংখ্যা বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৩২ কোটি হলেও আমরা কিন্তু আমাদের ভাষার শব্দগুলোর বানান সম্পর্কে এখনও একমত হতে পারিনি।
ইংরেজি ভাষার বর্ণমালা মাত্র ২৬ টা। তাই দিয়ে ইংরেজিতে সবকিছু লেখা যায়। সেই তুলনায় বাংলা ভাষার বর্ণমালা বেশ বড়। স্বরবর্ণ ১১ টা, ব্যঞ্জনবর্ণ ৩৯ টা, মোট ৫০ টা। এরপর আছে কার চিহ্ন, যুক্তবর্ণ ইত্যাদি নানা বিষয়।
আমরা এখনও ভাষার লিখিত রূপ বা বানান নিয়ে বিভ্রান্ত। ই,ঈ, হ্রস্ব-ইকার, দীর্ঘ-ঈ-কার উ,ঊ, হ্রস্ব-উ-কার,দীর্ঘ-ঊ-কার, ন,ণ, স,শ,ষ, জ,য ইত্যাদি বর্ণ, কার চিহ্ন নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ে বহু মানুষ। অনেকে বানান ভুলের আশঙ্কায় বাংলা লেখে না। অনেকে ইংরেজি হরফে বাংলা ভাষা লিখে মনের ভাব প্রকাশ করে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ও বাংলা ভাষাকে গণমানুষের ভাষা হিসেবে গ্রহণযোগ্য ও বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাংলা ভাষার লৈখিক রূপের কিছু পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি।
বাংলাভাষা লেখ্য রূপ যদি বাঙালিদের কাছেই স্বাচ্ছন্দপূর্ণ না হয় তাহলে বিদেশীদের কাছে তা কিভাবে জনপ্রিয়তা পাবে? স,শ,ষ এর যেকোনো একটা, ই,ঈ এর মধ্যে যে কোনো একটা, হ্রস্ব-ইকার, দীর্ঘ-ঈ-কার এর মধ্যে যে কোনো একটা উ,ঊ এর যে কোনো একটা, হ্রস্ব-উ-কার, দীর্ঘ-ঊ-কার এর যে কোনো একটা, ন,ণ, এর যে কোনো একটা, জ,য এর মধ্যে একটা, ত, ৎ এর মধ্যে একটা হলে কি ক্ষতি? একটু উদার দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে আমরা নিশ্চিতভাবে বাংলা ভাষাকে আরও সহজভাবে লেখার ব্যবস্থা করতে পারি বৈকি। এভাবে ভাষার লিখিত রূপ সহজ সরল করতে পারলে আমরা সহজে বিশ্ব দরবারে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব এবং সম্ভব হবে, ব্যবসা, বানিজ্যসহ সকল বিষয়ে যোগাযোগ সহজতর করা আমাদের দায়িত্ব। সেই দায়িত্বর হাত ধরে এগিয়ে যেতে যেতে তৈরি থাকতে হবে বাংলা ভাষাকে সম্মান জানানোর জন্য। বাংলা ভাষাকে বুকে লালন করে বাংলা ভাষায় সাইনবোর্ড-ই শুধু নয়; আমাদের এগিয়ে যেতে প্রত্যাহিক ভাষায় বাংলা ভাষার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে।
বাংলা ভাষায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য চলুন হাসি
চলুন সবাই বাংলাতে ভাই দেশকে ভালোবাসি
বাংলা হবে এগিয়ে যাওয়া আলোর জন্য কাজ
বাংলা হবে বাংলাদেশকে ভালোবাসাই আজ
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি