মানবতার সকল দোয়ার রুদ্ধ করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বহুদিন ধরে রাখাইনে বসবাসকারী রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর নিষ্ঠুর, অমানবিক ও পাষন্ড কায়দায় তান্ডব চালিয়ে তাদের বাপ দাদার চৌদ্দ গোষ্ঠির বসতবাড়ীঘর থেকে নির্মমভাবে বিদায় করে থাকে। তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা, নারী নির্যাতন থেকে শুরু করে ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ও লুটতরাজ করে পথের কাঙ্গাল বানিয়ে ছারখার করে দেয়। পিতামাতার কোল থেকে কেড়ে নিয়ে চোখের সামনে কোলের শিশুকে জ্বলন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ করে থাকে। এছাড়া যুবতী মেয়েদেরকে সেখানের উগ্রপন্থি বৌদ্ধ দানব ও সেনারা পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও সন্তানদের সামনে যেভাবে নারী নির্যাতন করে থাকে তেমনি স্বামীর সামনে স্ত্রীকেও নারী নির্যাতন করে থাকে। তাদের আর্ত চিৎকার ও আহাজারিতে আকাশ, বাতাস ও আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে যায়। এ অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে একজন ব্রিটিশ ও জার্মান সাংবাদিক উম্মাদের মতো হয়ে যায়। তাদের লেখনিতে তা ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
২০১৭ সালের আগে ও পরে অবর্ননীয় অত্যাচারিত হয়ে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। এখনও নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশ আসা তাদের অব্যাহত রয়েছে। তাদেরকে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের ঠিকানা ও চিকিৎসার দায়িত্ব কাধে নিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছে। যা মানবতার স্বপ্নিল ও অকৃত্রিম উদাহারণ হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে স্বীকৃত ও প্রশংসিত। তদোপরি তাদের ব্যাপারে আবেদন জানালে দুনিয়ার অনেক মুসলীম দেশসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, তুরস্ক, কানাডা, জার্মানী, সৌদি আরব, আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা ও জাতিসংঘ এগিয়ে এসেছে। এ ব্যাপারে হেগের আন্তর্জাতিক আদালত এক রায়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন ও জাতিসংঘ এ ব্যাপারে আহবান জানিয়ে আসলেও এ ব্যাপারে মিয়ানমার ০১/০২/২০২১ ইং ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী স্টেট কাউন্সেলর ও এনএলডি প্রধান (National League for Democracy) অং সান সুচি ও সেনা প্রধান মিন অং হ্লাইং তা মেনে নেয়নি। এছাড়া সুচি ১১ ডিসেম্বর ২০১৯ ইং হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে এক মামলায় সামরিক বাহিনীকে রক্ষা করার জন্য রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো গণহত্যার কথা বেমালুম অস্বীকার করে থাকে। মিয়ানমারের বন্ধু রাষ্ট্র চীন ও প্রতিবেশী ভারত যতটুকু করার তার ধারে কাছেও আসেনি। বরং বাংলাদেশে আশ্রিত নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ভরণ পোষনের জন্য প্রায় সময় কিছু মানবিক ত্রাণ সামগ্রী প্রেরণ করে থাকে। ওআইসি Organization of Islamic Council রোহিঙ্গাদের জন্য যা করার দরকার তা করছে না। রোহিঙ্গাদের পাশে থেকে মুসলীম রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্কের অবদানকে খাটো করে দেখার সুযোগ না থাকলেও ভ্রাতৃপ্রতিম সৌদি আরবের নির্লিপ্তাকে বাস্তবিক অর্থে মেনে নেয়ার মতো নহে।
এ সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের সাথে আলোচনার মাধ্যমে তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ হিসেবে বারংবার প্রচেষ্টা চালালেও তা কোনো কাজে আসছে না। যদিও রোহিঙ্গাদের আজ নেবে কাল নেবে বলে আলোচনা চালিয়ে গেলে এবং আশ্বস্থ করলেও বাস্তবে এমন কিছুকে মিয়ানমার আসলে কোনো কর্ণপাতই করছেনা। যদিও এ ব্যাপারে ক্ষমতাচ্যুৎ স্টেট কাউন্সেলর ও এনএলডি প্রধান অং সান সুচি ও সেনা প্রধান উদ্যোগ গ্রহণ করলে আরও
আগেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হয়ে অনেক আগেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হয়ে যেত বলে অভিজ্ঞজনদের অভিমত। আজ বাংলাদেশ সরকার ও এদেশের জনগণ যদি রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, প্রশ্রয়, অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা না করত তবে তাদের ভাগ্য ললাটে যে কী অবর্ননীয় দুঃখ কষ্ঠের মধ্যে পড়তে হত এর বর্ণনা করা বাস্তবিকই কঠিন, জটিল ও হৃদয় বিদারক বলা চলে।
অং সান সুচি এতদিন বিষধর গোকখোর সাপ নিয়ে ঘুমিয়েছেন। তার সাপ যখন তার সমর্থন নিয়েই রোহিঙ্গাদের ছোবল দিয়েছে, গিলে খেয়েছে, সুচি তখন আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন। সুচি তখন ভাবতেই পারেনি এই গোকখোর অপরিনামদর্মী সাপ একদিন তাকেই গিলে খাবে। রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের আচরন শুধু অমানবিকই নয় ন্যায়নীতির পরিপন্থিও। রাখাইনে তাদের ভিটে মাটি বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তাদের বসতভিটে এমন অচেনা জনপদে পরিণত হয়েছে। সেখানে কোনো এক সময় জনবসতি ছিল, এমনটা অনুমান করাও যেন এখন দুঃসাধ্য। কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের অধিকার হরণ করে সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারিতা চলুক তা গণতন্ত্রকামী কোনো দেশই মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ব্রিটিশের কাছ থেকে ১৯৪৮ সালে বার্মা, রেঙ্গুন বা মিয়ানমার স্বাধীন হলেও এদেশটিতে বেশী সময়ই সামরিক শাসন চলে আসছে।
মিয়ানমারের সেনা প্রধানের সাথে অং সান সুচির যখন বিরোধ চরমে পৌঁছেছে এবং সেখানে সেনা অভ্যুত্থানের ইঙ্গিত দেয় সেনা সমর্থিত মায়াবতি পত্রিকায়। যা ৩০/১২/২০২১ ইং বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের ক্ষমতায় রাখে স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, সীমান্তের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। এছাড়া পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ আসনও তাদের। গণতন্ত্র উত্তরণের আগে সংবিধান সংশোধন করে ক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখে টাইমাডো নামে পরিচিত মিয়ামনার সেনাবাহিনী। এ প্রসঙ্গে আরেকটু সামনে দৃষ্টিপাত করলে লক্ষ্য করা যায়, মিয়ানমারের স্বাধীনতার নায়ক জেনারেল অং সানের মেয়ে অং সান সুচি। সুচির যখন ২ বছর বয়স তখন তার বাবাকে হত্যা করা হয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র ২০ বছর আগে এ হত্যাকান্ড ঘটেছিল। তখন গোটা বিশ্বে মিস সুচি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে এক সময় মানবাধিকারের বাতিঘর বা আলোক বর্তিকা বলা হতো। যিনি একজন নীতিবান মানবাধিকার কর্মী হিসেবে দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারের শাসন ক্ষমতায় থাকা নির্দয় ও ক্ষমতা লিপ্সু সামরিক জেনারেলদের চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে জীবনের অনেক সময়কে জলাঞ্জলী দিয়েছেন। শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন সুচি। তবে রোহিঙ্গা প্রেক্ষাপটে দুনিয়া জুড়ে তাঁর প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরী হয়। জাতিগত নিধনের তকমা ও দোষারোপ করা হয় তাঁর ওপর। ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে অন্তত ১৫ বছর বন্দী জীবন কাটিয়েছেন সুচি।
অপরদিকে ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) প্রধান অং সান সুচি প্রেসিডেন্টসহ দলের অন্যান্য নেতাদের গ্রেফতার করে সেনাপ্রধান ক্ষমতা দখল করে এখন আলোচনায় মিন অং হ্লাইং। অবসরের মাত্র কয়েক মাস আগে নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করে সেনা প্রধান অং হ্লাইং। সেনা প্রধান মিন অং হ্লাইং ইয়াঙ্গুন ইউনিভার্সিটিতে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন। জানা যায়, মিন অং হ্লাইং খুব কম কথার মানুষ। তিনি প্রধান সামরিক বিশ্ববিদ্যালয় ডিফেন্স সার্ভিস একাডেমীতে ভর্তি হওয়ার আবেদন করে ১৯৭৪ সালে দৃতীয় দফায় সফল হন। তিনি ছিলেন একজন গড়পড়তার ক্যাডেট। যাকে উন্নত মান সম্মানের ক্যাডেট হিসেবে বিবেচনার নহে। সেনা থেকে রাজনীতিক, গণতান্ত্রিক পালা বদল যখন শুরু হয় তখন ২০১১ সালে সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব নেন মিন অং হ্লাইং। সুচির প্রথম দফার ক্ষমতার সময় মিন অং হ্লাইং নিজেকে একজন স্পষ্টভাষী সেনা থেকে একজন রাজনীতিক হিসেবে পাল্টে ফেলেন। তখন থেকেই তিনি নানা রকম সরকারি কর্মকান্ডে নিজেকে জড়িত করেন এবং ফেসবুকে প্রচার করতে থাকেন। ২০১৭ সালে তার সেনাবাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলীম সংখ্যালঘুদের ওপর অশ্রুসিক্ত নৃশংস নারকীয়তা সংঘটিত করে। ২০১৬ সালে আরও ৫ বছরের জন্য নিজের ক্ষমতার মেয়াদ বৃদ্ধি করিয়ে নেন সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং। যদিও সেনাবাহিনীর নিয়মিত রদবদলের অংশ হিসেবে সে সময় তাঁর পদত্যাগ করার কথা। পদত্যাগ না করে মেয়াদ বাড়ানোয় বিস্মিত হয় পর্যবেক্ষকরা।
আরও জানা যায় ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ বার্মা (বর্তমানে মিয়ানমার) নামে দেশটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬২ সাল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিন অং হ্লাইংয়ের মতো ক্ষমতা দখল করে সেনাপ্রধান নে উইন ও সামরিক শাসনের মাধ্যমে বহু বছর দেশটি শাসন করে থাকে। ১৯৮৮ সালে স্বাধীনতার নায়কের কন্যা অং সান সুচি নিজ দেশে ফিরে আসেন। গণতন্ত্রের দাবীতে সামরিক স্বৈরাচার, স্বৈরশাসক ও এক নায়কের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভচারীদের সামরিক জান্তার পোষ্য বাহিনী গুলি চালালে গণতন্ত্রকামী শতাধিক নিরীহ মানুষ নিহত হয়। ১৯৮৯ সালে সামরিক জান্তার ক্রমবর্ধমান স্পষ্টভাষী বিরোধীতাকারী ও সমালোচক হিসেবে পরিচিত সুচিকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৯০ সালের ২৭ মে দেশটির জাতীয় নির্বাচনে (Parliament Election) সুচি প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) দুর্দান্ত বা অস্বাভাবিক বিজয় ছিনিয়ে আনলেও সামরিক বাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি।
১৯৯১ সালের অক্টোবর সেনাশাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ন আন্দোলন, সংগ্রামের জন্য সুচিকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর গণতান্ত্রিক মিয়ানমারের প্রথম নির্বাচনে ২০ বছরের মধ্যে জান্তাপন্থি একটি দল জয়লাভ করে। তবে ব্যাপক ভোট কারচুপি পক্ষপাতিত্বের দাবী করে এই ভোট গ্রহণ বর্জন করা হয়ে থাকে। ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর দুই দশকের বেশী সময় দরে গৃহবন্দী থাকার পর অং সান সুচি মুক্তি পায়। ২০১২ সালে উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে
প্রথমবারের মতো সংসদে আসেন সুচি। ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর ১৯৯০ সালের পর প্রথম প্রকাশ্য সাধারণ নির্বাচনে এনএলডি (National Leauge for Democracy) দুর্দান্ত বিজয় লাভ করে। সংবিধানের অধীনে সেনাবাহিনী ক্ষমতা ধরে রাখতে প্রেসিডেন্ট হতে দেয়নি। তবে সরকারের নেতৃত্ব দিতে তার জন্য স্টেট কাউন্সেলর (State Councilar) পদ তৈরী করা হয়। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আরাকান বিদ্রোহীরা পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে সামরিক ফাঁড়িতে হামলা চালায়। এতে বেশ কিছু সামরিক বাহিনীর সদস্যকে হত্যা করা হয়। এর প্রতিক্রিয়া সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা মুসলীম জনগোষ্ঠির ওপর বর্বরতম, ব্যাপক নৃশংস হামলা ও ধ্বংস যজ্ঞ চালায়। ফলশ্রুতিতে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা সবকিছু হারিয়ে পথের কাঙ্গাল হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর সুচি হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে এক মামলায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে রক্ষা করার জন্য রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো অমানবিক, নৃশংস অত্যাচার ও গণহত্যার কথা বেমালুম অস্বীকার করে থাকে।
২০২০ সালের ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে এনএলডি সংসদে সম্পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয় লাভ করে। ২০২১ সালের ২৯ জানুয়ারি নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে বলে সামরিক বাহিনীর অভিযোগ খারিজ করে দেয় মিয়ানমারের নির্বাচন কমিশন। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ভোট জালিয়াতির অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ও করোনা ভাইরাস সংকটেও নির্বাচন স্থগিত করতে অস্বীকার করায় এক বছরের জন্য দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। অং সান সুচি মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট, এনএলডির শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা ও পার্লামেন্টের অনেক সদস্যকে গ্রেফতারের পর তৃণমূলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদেরকে গ্রেফতারের ব্যাপক অভিযান শুরু করেছে দেশের সেনা ও পুলিশ বাহিনী। এরই মধ্যে মিয়ানমারের সামরিক শাসন, জরুরী আইন ও নির্বাচিত এনএলডি প্রধান অং সান সুচিকে গ্রেফতার ও গৃহবন্দী রাখার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিংসঘ, ইইউসহ জি-৭ অন্তর্ভূক্ত দেশ সমূহ। এরই মধ্যে সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও সুচির মুক্তির দাবীতে ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার ও শ্রমিকসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ প্রতিবাদে নেমেছে। ৮ নভেম্বর নির্বাচনে সুচির দল পায় ৩৪৬ আসন। পার্লামেন্টে সংখ্যা গরিষ্টতার জন্য ৩২২টি আসনই যথেষ্ট। কিন্তু সেনা সমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) পায় মাত্র ৩২টি আসন। গৃহবন্দী এনএলডি প্রধান অং সান সুচি ও ক্ষমতাদখলকারী মিন অং হ্লাইংয়ের ভাগ্যে কি আছে জানি না। সেখানে ১ ফেব্রুয়ারি সোমবার সকালে সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং সব ক্ষমতা হাতে নিয়ে ১ বছরের জন্য দেশটিতে সামরিক শাসন ও জরুরী আইন জারি করেছে। দেশটিতে যাতে গণতন্ত্রের শাসন জারি হয় এবং অং সান সুচিকে যাতে অবিলম্বে মুক্তি দেয়া হয় এজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ, ইইউ ও জি-৭ তথা কানাডা, ফ্রান্স, ইতালী, জার্মানী, জাপান, ইউএসও, ইউকে তীব্র প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছে। এরই মধ্যে চীনের ভেটোর কারণে নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত হয়ে যায়। এছাড়া গণতন্ত্রকামি অনেক দেশে মিয়ানমারে সামরিক শাসনের অবসান, অং সান সুচির মুক্তি ও গণতন্ত্রের ধারাকে অবিচল রাখার পক্ষে আহবান জানাচ্ছে। অনেকেই বলেছে নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক কোনো সরকারকে এমনিভাবে বন্দুকের নলের মাধ্যমে সরিয়ে দিয়ে সামরিক শাসন জারি করা গণতন্ত্রকামী কোনো রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রকামী জনগণের আদৌ কাম্য হতে পারে না। যদিও রোহিঙ্গা সমস্যার মানবিক সমাধানে সুচির নেতিবাচক মনোভাবকে বিশ্ববাসী ও নির্যাতিত রোহিঙ্গারা তা মেনে নিতে পারেনি।
যাতে অবিলম্বে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হয় বাংলাদেশে আশ্রিত প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা যাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফিরে গিয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপন ভোগসহ তাদের বাড়ীঘর, ক্ষেতখামার, হারানো ব্যবসা বাণিজ্য ফিরে পায় ইহাই প্রত্যাশা। তবে নির্ভরযোগ্য তথ্য ও সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের বসবাসকৃত জায়গাজমি, ঘরবাড়ি, ব্যবসা বাণিজ্য সবকিছু সেনাবাহিনী ও তাদের আশ্রয়, প্রশ্রয়ে থাকা উগ্রপন্থিরা বুলডোজার চালিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। এখন হয়তো বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কোনমতেই তাদের বাড়ীঘর ব্যবসা বাণিজ্যের স্থান চেনার মতো কোনো অবস্থা সেখানে আর বিদ্যমান নেই। মাথার ওপরে নীল আকাশ ও নীচে মাটি। এর বাইরে কোনো কিছু নেই রাখাইনের মুসলমানদের স্থাপনায়। বড় বড় গাছ ও গৃহপালিত পশু আগেই লুট করে নিয়েছে কুলাঙ্গার আর্মি ও বৌদ্ধ উগ্রপন্থিরা। সুচির যত দোষই থাকুক না কেন, কোনো অবস্থাতেই এনএলডির নির্বাচিত প্রধান হিসেবে গৃহবন্দী করিয়ে রাখা কারও কাম্য হতে পারে না। গণতন্ত্রই সারা দুনিয়ার মানুষের একমাত্র রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা। সেখানে সেনাশাসন, স্বৈরাচারিতা ও একনায়কতন্ত্র বিষাদের কালো ছায়া হিসেবে অলংকিত। পরিশেষে বলব, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, অসহায় বাংলাদেশে আশ্রিত ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানদের যাতে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে পূনর্বাসনসহ থাকার ব্যবস্থা করা ইহাও জাতিসংঘসহ দুনিয়ার ক্ষমতাধর দেশ, ভ্রাতৃপ্রতীম মুসলীম রাষ্ট্র, মানবাধিকার সংস্থা ওআইসিসহ বিশ্বের সকল দেশের সহযোগিতা ও সমর্থন পাথেয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত রোহিঙ্গাদের একটি মর্মস্পর্শী চিৎকার আজও বারবার কানে ভেসে ওঠে। আমরা শিশু, এমনভাবে পুড়িয়ে মারবেন না, আমাদেরকে নারী নির্যাতন করবেন না। হে আল্লাহ আমাদিগকে রক্ষা কর। তুমি ছাড়া আমাদিগকে রক্ষা করার জন্য ইহকাল ও পরকালে আর কেহই নাই। হাসবুনাল্লাহু ওয়ানিমাল ওয়াকিল অর্থাৎ আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। রোহিঙ্গাদের অশ্রুসিক্ত ও নিপীড়ন ও আর্তনাদ যখন ভেসে ওঠে তখন দানব, রাক্ষস ছাড়া কোনো সভ্য মানুষ কোনো অবস্থাতেই স্থির থাকার কথা নয়।
এ.কে.এম শামছুল হক রেনু
লেখক কলামিষ্ট