পুঠিয়ার শ্রমিক নেতা নূরুল ইসলাম হত্যা মামলায় বাদীর এজাহার বদলে দেয়ার অভিযোগে রাজশাহীর পুঠিয়া থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাকিল উদ্দীন আহমেদের (৪৮) বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পিবিআই-এর বিশেষ পুলিশ সুপার আহসান হাবিব পলাশের নেতৃত্বে একটি টিম ইতিমধ্যেই হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থলসহ পুঠিয়া শ্রমিক অফিস এলাকা পরিদর্শন করেছে। এ সময় তারা বাদীর পরিবার ও এলাকাবাসীর সঙ্গেও কথা বলেছেন।
এ তথ্য নিশ্চিত করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শামীম মঙ্গলবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) জানান, এই মামলার তদন্তে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সোমবার পিবিআইয়ের একটি টিম ঢাকা থেকে পুঠিয়ায় আসে। এ সময় তারা হত্যাকান্ডস্থল পরিদর্শন করে বাদীর পরিবারের সাথে কথা বলেছেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে মামলার বাদী নিহত নূরুল ইসলামের মেয়ে নিগার সুলতানা জানান, ঢাকা থেকে পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা এসে তার কাছে পুরো ঘটনাটি শুনেছেন। হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থলও পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তিনি প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরে আসামিদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে পিতা হত্যার সঠিক বিচার চেয়েছেন।
এদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত ২৪ জানুয়ারি রোববার ওসি শাকিল উদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করে। দুদকের রাজশাহী জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আল-আমিন এ মামলা করেন। পুলিশ পরিদর্শক সাকিল উদ্দীন আহমেদ বর্তমানে পুলিশের সিলেট রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) কার্যালয়ে কর্মরত আছেন। তার গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ডা. সামিল উদ্দীন আহমেদ শিমুল তার ভাই। এজাহার পরিবর্তনের বিষয়টি ধরা পড়ার পর ওসি সাকিলকে সাময়িক বরখাস্ত করে সিলেট রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়।
দুদকের দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, নূরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি পুঠিয়া থানার সড়ক ও পরিবহন মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে তিনি আবারও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং সর্বোচ্চ ভোট পান। কিন্তু নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ফল পরিবর্তন করে আবদুর রহমান পটল নামে এক ব্যক্তিকে সাধারণ সম্পাদক পদে বিজয়ী ঘোষণা করে। এ নিয়ে নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ করে নূরুল ইসলামসহ তিনজন বাদী হয়ে মামলা করেন। এরপর থেকে আবদুর রহমান পটল এবং তার সহযোগীরা নুরুল ইসলামকে বিভিন্নভাবে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আসছিলেন।
এরপর ২০১৯ সালের ১০ জুন থেকে নুরুল ইসলাম নিখোঁজ হন। গত ১১ জুন রাজশাহীর পুঠিয়া থানাধীন কাঠালবাড়ীয়া এলাকার এএসএস ইটভাটা থেকে শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলামের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত নুরুল ইসলাম ওই উপজেলার ধোপাপাড়া গ্রামের মৃত কালুর ছেলে। এ ঘটনায় সেদিনই তার মেয়ে নিগার সুলতানা আটজনের নাম উল্লেখ করে পুঠিয়া থানার তৎকালীন ওসিকে একটি এজাহার দেন। সেই এজাহারে শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে পুঠিয়ার ওসির অবৈধ হস্তক্ষেপের বিষয়টি উল্লেখ ছিল। এ কারণে ওসি সাকিল উদ্দীন আহমেদ এজাহারটি রেকর্ড না করে নিগার সুলতানাকে তা সংশোধন করতে বলেন। নিগার সুলতানা ওসির বিষয়টি বাদ দিয়ে পুনরায় থানায় এজাহার দাখিল করেন। তখন এজাহারটি গ্রহণ করেন এবং কিছু সাদা কাগজে নিগার সুলতানার স্বাক্ষর নিয়ে তাকে চলে যেতে বলেন।
পরবর্তীতে নিগার সুলতানা পুঠিয়া থানা থেকে এজাহার ও মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীর কপি সংগ্রহ করে দেখেন, প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে আসামিদের নাম-ঠিকানা লেখার কলামে ‘অজ্ঞাতনামা’ লেখা আছে। আবার তার উল্লেখ করা আটজন আসামির পরিবর্তে সেখানে ছয়জনের নাম আছে। অথচ তিনি পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানাসহ আটজনকে আসামি করেছিলেন। এ ঘটনায় নিগার সুলতানা এই বিতর্কিত এজাহারের বিরোধিতা করে হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট রাজশাহীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশনা দেন। এরপর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান তালুকদার বিচার বিভাগীয় তদন্ত শেষে ওসির কারসাজির বিষয়টি উল্লেখ করে প্রতিবেদন দাখিল করেন।
ওসির বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলার এজাহারে আরো বলা হয়, ওসি সাকিলের এজাহার পরিবর্তনের বিষয়টি পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গলের প্রবিধান ২৪৩ ও ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তিনি দন্ডবিধির ১৬৬/১৬৭/২১৭/২১৮ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। তাই তার বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের করা হলো। তদন্তকালে এসব অপরাধের সঙ্গে আর কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।