কৃষকের ইরি ধান চাষ করে ধান উৎপাদন করতে সার, বীজ, কীটনাশক, নিড়ানী, কৃষি শ্রমিক ইত্যাদিতে কি পরিমান ব্যয় এবং বর্তমানে ধানের বাজার মূল্যেতে কি কৃষক লাভবান হবেন না ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ধান চাষে অগ্রহ হারাবেন না ধান চাষে আগ্রহ ফিরে পাবেন এ সম্পর্কে লিখার জন্য, তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করলাম। কিন্তু রোববার সকাল সকাল কয়েক জনের সাথে পদ্মা নদীর ধারে ঘুরতে গিয়ে দেখলাম পদ্মার বেহাল দশা, বালু আর বালু জেগে উঠেছে চর, ডুবো চর, জেগে উঠা চরে সবুজের সমাহার, পিয়াজ, রশুন, রেগুন, মসরি, পটল, করলা প্রভূতি চাষ করেছেন চাষীরা। এক সময়ের খর¯্রােত নেই পদ্মার, নদীর গভীরতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। পদ্মার বেহালদশা দেখে মনে হচ্ছে অদূরভবিষ্যতে নৌকার পরিবর্তে গরুর গাড়ি চলবে, মানুষ পায়ে হেঁটে কিংবা হোন্ডা, বাইসাইকেলে পারাপার হবেন। এনদীর বেহালদশার প্রধান কারণ মরণ বাঁধ ফারাক্কা, তাই লিখার থিম পরিবর্তন করে পদ্মার বেহালদশা সম্পর্কে লিখার চেষ্টা করলাম।
বর্ষাকালে ভারত অন্য সময়ের তুলনায় ফারাক্কায় বেশি গেট খোলে আমাদের দেশকে বন্যার পানিতে ভাসায়। ফারাক্কার গেট সংখ্যা ১০৪টি এর মধ্যে ১০০টি গেট খুলে দিযে থাকেন। এতে ১১ লাখ কিউসেক পানি সরে যাবে, যাতে বিহারের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়।
বর্ষা মৌসুমে প্রতিবছর একযোগে ফারাক্কার সব গেটগুলো খুলে দেয়ার কারণে বাংলাদেশের বন্যা ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনে। পদ্মার আর সেই আগের অবস্থা নেই। এককালের প্রমত্তা পদ্মা মরা গাঙে পরিণত হয়েছে অনেক আগেই। তার বুকে অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। গত শুকনো মৌসুমেও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি পদ্মার কী করুণ হাল। গত ৪০ বছর ভারতের পানি ছিনতাইয়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে পদ্মার পানি ধারণ ক্ষমতা অবিশ্বাস্য রকম হ্রাস পেয়েছে। একসময় এই নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা ছিল ২৫ লাখ কিউসেক। এখন তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর শাখা নদীগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতাও হ্রাস পেয়েছে। কোন কোন নদী মরে গেছে।
রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধও বিপন্ন হয় বর্ষা মৌসুমে।আর এখন পদ্মার বুকজুড়ে ধু ধু বালুচর। পদ্মার এই মুমূর্ষু হাল ও পানিশূন্যের কারণ ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারতের নির্বিচার পানি প্রত্যাহার। পদ্মার পানি ভাগাভাগি নিয়ে একটা চুক্তি আছে বটে, তবে সেই চুক্তি মোতাবেক পানি বাংলাদেশ কোনো বছরই পায়নি। গত বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সময়ে ১৫টি চক্রে বাংলাদেশ পানি কম পেয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৮৬৪ কিউসেক। ফারাক্কায় বাঁধ দেয়ার পর থেকে প্রতিবছর শুকনো মৌসুমে পানির অভাবে শুকিয়ে মরা এবং বর্ষা মৌসুমে পানিতে ডুবে মরা বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যলিপিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য ফারাক্কা বাঁধ এক মরণ ফাঁদ। এই বাঁধের যখন পরিকল্পনা করা হয় তখনই বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন পানি, প্রকৃতি, পরিবেশ, নদী প্রবাহ, নৌ-যোগাযোগ, অর্থনীতি, মানববসতি প্রভৃতির ওপর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ফেলবে এ বাঁধ। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতেও। কিন্তু ভারত তখন বিশেষজ্ঞ অভিমতকে গ্রাহ্যে আনেনি। চিরবৈরী পাকিস্তানের পূর্বাংশ পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশকে জব্দ করার জন্য কিংবা দাবিয়ে রাখার জন্য ভারত তখন মরিয়া হয়ে এ বাঁধ প্রকল্প গ্রহণ করে। বাঁধের পরিকল্পনা করা হয় ১৯৫১ সালে। নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৬১ সালে এবং শেষ হয় ১৯৭০ সালে। বাঁধ পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় ১৯৭৪ সালে। সেই থেকে এ পর্যন্ত এ বাঁধ বাংলাদেশে যে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, তাতে বিশেষজ্ঞদের অভিমত সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের কতটা ক্ষতি হয়েছে এবং তার অর্থমূল্য কত হতে পারে তা নির্ণিত না হলেও অনেকেই মনে করেন, এত ক্ষতি হয়েছে যে, তা নির্ণয়যোগ্য নয়। প্রাকৃতিক ব্যবস্থা, মানবিক কাজকর্ম ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর অপূরণযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে মরু ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততার বিস্তার ঘটেছে। পানি ও নদী ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। কোন কোন স্থানে খরা মৌসুমে নলকূপগুলিতে পানি উঠতে চাই না। অকেজো হয়ে পড়ে, খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। ভূমি গঠন ব্যাহত হয়। ভূমির উর্বরাশক্তি কমে গেছে। কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। নৌপথ সঙ্কুচিত হয়েছে। নৌ-বাণিজ্য কমে গেছে। মৎস্য চাষ ও পশু পালন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যা ও নদী ভাঙন ভয়ঙ্কর রূপ পরিগ্রহ করেছে। আবহাওয়ায় পরিবর্তন ঘটেছে। জীব ও প্রাণবৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়েছে। গৃহচ্যুতি, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সামাজিক অস্থিরতা ও ক্লেশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সেই শুরু থেকে বাংলাদেশের মানুষ সোচ্চার দাবি তুলেছে, ‘মরণ বাঁধ ফারাক্কা। ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও’। ১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যখন ফারাক্কা লংমার্চ হয় তখন এটিই ছিল লাখ লাখ মানুষের কণ্ঠে প্রধান ধ্বনি। তখন অনেকেই ফারাক্কা লংমার্চকে ভিন্ন চোখে দেখছিলেন। তাদের মতে, এটা ছিল ‘অযৌক্তিক ভারত বিরোধিতা’, ‘পাকিস্তানি মানসিকতা’ ও ‘প্রহসন’। এখন প্রমাণিত হয়েছে তখন যে লংমার্চ হয়েছিল তা না ছিল অযৌক্তিক ভারত বিরোধিতা, না ছিল পাকিস্তানি মানসিকতা এবং না ছিল প্রহসন।
বিস্ময়কর ব্যাপার, তখন ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেয়ার যে দাবি জানিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ এখন সেই দাবিই জানাচ্ছে ভারতের মানুষ। কারণ, ফারাক্কা বাঁধ শুধু বাংলাদেশের মানুষেরই অপরিমেয় ক্ষতির কারণ হয়নি, ভারতের মানুষেরও ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি জেলার লাখ লাখ মানুষকে পথে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের কতটা ক্ষতি সাধিত হয়েছে তার পরিসংখ্যান পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার দিতে পারবে হয়তো। দেড় দশক আগের এক তথ্যচিত্রে দেখা যায়, মালদহ জেলার কালিয়াচক ১, ২, ৩ নং ব্লক এবং মানিক ব্লকে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার একর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মুর্শিদাবাদ জেলায় ৫০/৬০ হাজার একর জমি একইভাবে গঙ্গা গ্রাস করেছে। গঙ্গাতীরবর্তী এলাকার ৪০ হাজার পরিবার নিঃস্ব ভিখারীতে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ পেশাচ্যুত হয়েছে। আমের ফলন, আখ ও তুঁত চাষ হ্রাস পেয়েছে। জনস্বাস্থ্য, প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর পড়েছে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া। ফারাক্কার গেট বন্ধ থাকার কারণে উজানে গঙ্গা মাইলের পর মাইল নাব্য হারিয়েছে। পলি পড়ে এর বুক ভরাট হয়ে গেছে। অসংখ্য চর সৃষ্টি হয়েছে। বন্যা ও নদীভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিগত দেড় দশকে সার্বিক পরিস্থিতির যে আরো অবনতি ঘটেছে তাতে সন্দেহের কারণ নেই।
বহুদিন ধরেই মালদহ-মুর্শিদাবাদ জেলার গঙ্গা তীরবর্তী দুর্ভোগ ও বিপর্যয়কবলিত মানুষ ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। একই সঙ্গে তারা ক্ষতিপূরণ, ভূমি ও পুনর্বাসন দাবি করে আসছে। অব্যাহত বন্যা ও নদীভাঙন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণেরও তারা দাবি জানিয়ে আসছে। বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গের জন্যও ফারাক্কা বাঁধ বড় রকমের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, পার্শ্ববর্তী বিহারও ফারাক্কা বাঁধের কারণে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। সেখানে চলমান বন্যায় ১০ লাখের বেশি মানুষ ও ২ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিহার রাজ্য সরকারের দাবি, ফারাক্কা বাঁধের কারণেই এই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং প্রায় প্রতিবছরই রাজ্যে বন্যা ও নদীভাঙনের শিকার হচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো উন্নয়ন প্রক্রিয়া ও জনজীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে, তেমনি মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ভারতের বিহার রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার বিগত ২০১৭ খ্রি. ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করে বিতর্কিত ফারাক্কা বাঁধকে পুরোপুরি সরিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ফারাক্কা বাঁধের জেরে গঙ্গাতে যে বিপুল পরিমাণ পলি পড়েছে তার জন্য প্রতিবছর বিহারকে বন্যায় ভূগতে হচ্ছে এবং এর একটা স্থায়ী সমাধান হলো ফারাক্কা বাঁধটাই তুলে দেয়া। ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের নানা আপত্তি আছে দীর্ঘদিন ধরেই। কিন্তু ভারতের একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও মূখ্যমন্ত্রী এই প্রথম ফারাক্কা বাঁধ একেবারে প্রত্যাহারের দাবী তোলেন। ভারতের ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির ওপর বিরাট প্রভাব পড়ছে। ফারাক্কা বাঁধের ফলে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বন্ধ হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ ন্যায্য পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, পলি জমে নদী তল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানির চাপ সহ্য করতে পারেনা নদী। ফলে প্রায়ই দেখা দিচ্ছে বন্যা। তেমনি শীত মৌসুমে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশ মারাত্মক পানিশূণ্যতার সম্মুখীন হচ্ছে, যা ক্ষুদ্র দেশটির সার্বিক জীবনযাত্রা ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া মারাত্মক ভাবে ব্যাহত করছে। শুকনো মৌসুমে হ্রাসকৃত পানি প্রবাহের ফলে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকার কৃষিক্ষেত্র মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। বিশেষ করে হার্ডিঞ্জ সেতুর কাছে পানি প্রবাহ সর্বকালের সর্বনিম্ন ১৪ ফুটের নিচে নেমে আসায় জমির ফসল বিনষ্ট হচ্ছে এবং এর ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা বলে জানা যায়। এ ছাড়া সেচের পানির অভাব, জমির আর্দ্রতা হ্রাস ও জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে দেশের গঙ্গাবাহিত ৫০ লক্ষ একর জমি মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় ১৯৭৬ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত শুধুমাত্র কৃষিক্ষেত্রেই বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বছরে ৫০০ কোটি টাকারও অধিক। আর প্রাকৃতিক ও নীতিসম্মত এ প্রবাহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ২৩০০ কোটি টাকার মত ক্ষতি হচ্ছে। এতেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ফারাক্কা কত ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে।
ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে পরিবেশগত বিপর্যয়ের শিকারে পরিণত হয়েছে। হুগলী নদীর উজান ¯্রােতে একদিকে যেমন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশের কারণে সুন্দরবন অঞ্চলের বিরাট অংশ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, অন্যদিকে এ বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে বাংলাদেশের একমাত্র ‘ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল’ সুন্দরবন এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সেখানকার প্রধান অর্থকারী গাছ সুন্দরী ধ্বংসের মুখোমুখি। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ধারণা সুন্দরবনের ৬০ শতাংশ বনজ সম্পদের এ মূল্যবান বৃক্ষের সঙ্গে গেওয়া, কেওড়া ইত্যাদি গাছ উল্লেখযোগ্য হারে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এতে পরিবেশের এক বিরাট ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। অতিমাত্রায় লবণাক্ত পানি মৎস্য সম্পদ ও উপকূলবর্তী কৃষি সম্পদেরও মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে চলেছে। বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, ফরিদপুর ও রাজশাহী জেলার জলবায়ু ক্রমাগত মরুময়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। হ্রাসকৃত পানি প্রবাহের ফলে নদী ভরাট হয়ে যাওয়া, গতি পরিবর্তিত হওয়া, উজানে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ ইত্যাদি কারণে মৎস্য সম্পদ দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। সত্তর দশকে যেখানে খোলাপানির মাছের পরিমাণ ছিল ২৭৮ হাজার মেট্রিক টন সেখানে ১৯৯১-৯২ সালে তা মাত্র ১৮৫ হাজার মেট্রিক টনে নেমে এসেছে। বর্তমানে টাকার অংকে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। ফারাক্কা সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান না হলে ভবিষ্যতে মৎস্য সম্পদের ওপর আরো নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফারাক্কা প্রভাবিত বন্যার ফলে কোটি কোটি টাকার সম্পদ এবং জানমালের ক্ষতি হচ্ছে। বন্যা সমস্যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব ফেলে চলেছে।
আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে গঙ্গা নদীর ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আন্তর্জাতিক আইনে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেকটি তীরবর্তী রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে আন্তর্জাতিক নদীকে এমনভাবে ব্যবহার করা যাতে অন্যান্য তীরবর্তী রাষ্ট্রের সহজাত অধিকার ও স্বার্থের ক্ষতি না হয়। আন্তর্জাতিক নদীর যথেচ্ছ ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত নয়। ১৯৬৬ সালের ঐবষংরহশর জঁষবং এর নীতিতে বলা হয় যে, আন্তর্জাতিক নদী কোন দেশ যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারবেনা। ১৯৩৩ সালের মন্টিভিডিও ঘোষণা, ১৯১১ সালের মাদ্রিদ ঘোষণা ও ১৯৬১ সালের সলস্ বার্গে ঘোষণায় ওই নীতির প্রতিফলন ঘটে। ১৯৫৯ সালে মিশর ও সুদানের মধ্যে নীলনদ চুক্তি, ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধুনদী চুক্তি, ১৯৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে কলম্বিয়া নদী চুক্তিসমূহ আন্তর্জাতিক নদীর উপর স্ব স্ব তীরবর্তী দেশের সমান অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনে বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক নদীর উপর কোন প্রকল্প নির্মাণের পূর্বে বিশেষ করে যদি সেই প্রকল্পের প্রতিক্রিয়া অন্য দেশে বিরূপ প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে তবে সেই নির্মাণকারী রাষ্ট্র অপর তীরবর্তী রাষ্ট্রসমূহকে সেই প্রকল্প সম্পর্কে “অগ্রিম অবহিত” (চৎরড়ৎ ঘড়ঃরপব) করতে হবে।
দেখা যাচ্ছে, গঙ্গা নদীর উপর ভারত যে বাঁধ নির্মাণ করেছে তা আন্তর্জাতিক রীতিবিরুদ্ধ। আন্তর্জাতিক আইনের এটি সুস্পষ্ট লংঘন। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গাকে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক পানি প্রবাহের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। ভারত নিজ দায়িত্বে ফারাক্কা বাঁধ সম্পর্কে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারকে অবহিত করেনি। ১৯৬০ সাল থেকে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলাকালে ভারত ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রাখে এবং পরবর্তী সময়ে সমঝোতা ব্যতিরেকে গঙ্গার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে চলেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, ফারাক্কা বাঁধ না থাকায় যে প্রতিক্রিয়া হবে, তা কি বাঁধ থাকার ফলে যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তার চেয়ে বেশি? মোটেই নয়। বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে প্রতিবছর যে আর্থিক, পরিবেশগত ও মানবিক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে, তার কোনো তুলনাই হতে পারে না। বাঁধ থাকলে এই ক্ষয়ক্ষতি আরো বিপুল আকারে বছরের পর বছর ধরে হতে থাকবে। তাছাড়া যে উদ্দেশ্যের কথা বলে এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল, সে উদ্দেশ্যে সফল হয়নি। বলা হয়েছিল, কলকাতা বন্দর রক্ষা এবং ভাগীরথী ও হুগলি নদীর নাব্য বৃদ্ধির জন্যই এ বাঁধ। তখনই অবশ্য আন্তর্জাতিক পানি বিশেষজ্ঞ ড. আর্থার টি ইপেন বলেছিলেন, গঙ্গার মিঠাপানি হুগলিতে প্রবাহিত করে কলকাতা বন্দরের সমস্যার সমাধান হবে না, বরং এতে মিঠাপানি ও চর পড়ার সমস্যা সৃষ্টি হবে। ভারতের বিশিষ্ট পানিবিশেষজ্ঞ কপিল ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। কারণ এতে ফারাক্কা ও তার আশেপাশের অঞ্চলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। তাদের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষের ধ্বনি ‘মরণ বাঁধ ফারাক্কা ভেঙে দাও/ গুঁড়িয়ে দাও’, এখন ভারতের মানুষের ধ্বনিতেও পরিণত হয়েছে। এই ‘রাজনৈতিক বাঁধ’ দু’দেশের সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের মধ্যে যে দুর্ভোগ, কষ্ট, বঞ্চনা ও বিপর্যয় ডেকে এনেছে তাতে এই বাঁধ রাখার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণে থাকতে পারে না। দু’দেশের মানুষ যদি এই বাঁধের বিরুদ্ধে একট্টা হয়ে দাঁড়ায় তবে আশা করা যায়, একদিন বাঁধ সরিয়ে নিতে বাধ্য হবে ভারত সরকার। সঙ্গতকারণেই বাংলাদেশ সরকারকেও এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। কারণ এ বাঁধের সবচেয়ে বড় শিকার বাংলাদেশ ও এ দেশের মানুষ।
লেখক : মোঃ হায়দার আলী, সভাপতি, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা