৪ঠা মার্চ ঢাকা বেতার কেন্দ্র ও বর্তমান বাংলাদেশ টেলিভিশনের নামকরণ দিবস। ১৯৭১ সালের ৪ঠা মার্চ বৃহস্পতিবার পাকিস্তানিদের শোষন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে শিল্পীগোষ্ঠীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঢাকা বেতার কেন্দ্র ও ঢাকা টেলিভিশনের নাম ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেন। একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ মাসের চতুর্থ দিন থেকে ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ এবং ‘ঢাকা টেলিভিশন’ নামে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করে।
পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর স্বৈরাচার শাসন, নির্যাতন, নিষ্পেশন, শোষন, নিপীড়নসহ সর্বোপরি কালো থাবার কবল থেকে মুক্তি পেতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলসূতিতে তৎকালীন ‘রেডিও পাকিস্তান ঢাকা’ এর নাম বদল করে নতুন নাম রাখা হয় ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’। এ ছাড়া ‘টেলিভিশন পাকিস্তান’ এর নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখা হয় ‘ঢাকা টেলিভিশন’।
একাত্তরের ওইদিনে স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশব্যাপী পালিত হয় হরতাল। গোটা দেশে এদিন ভোর ছয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। মুক্তিপাগল বাঙালির দিনটি কেটেছে বিক্ষুব্ধ শোভাযাত্রা, গায়েবানা জানাজা, সভা ও স্বাধীনতার শপথ নেয়ার মধ্য দিয়ে। তবে এর আগে থেকেই প্রতিদিন একটু একটু করে বদলে যাচ্ছিল দৃশ্যপট। বেগবান হয়ে উঠছিল মুক্তি আন্দোলন। ঘর ছেড়ে রাজপথে নেমেছিল নানা শ্রেণি-পেশার, নানা বয়সের মানুষ। অগ্নিঝরা মার্চের ১ থেকে ৪ তারিখের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তিন শতাধিক ছাত্র-জনতা। এতে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে স্বাধীনতাকামী মানুষ। হত্যা নির্যাতন বন্ধে পাকিস্তানিদের হুঁশিয়ার করে দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঐতিহাসিক ১৯৭১ সালের ৪মার্চের দিনে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ঢাকায় সাময়িকভাবে কার্ফ্যু তুলে নেয়া হলেও চট্টগ্রাম, খুলনা ও রংপুরে তা বলবৎ থাকে। ঢাকা বিমান বন্দরে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। খুলনায় হরতাল পালনকালে নিরস্ত্র জনতার ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিক্ষিপ্ত গুলিবর্ষণে ৬ জন নিহত হয় ও ২২ জন আহত হয়। চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে ৩ ও ৪ মার্চে সর্বমোট ১২০ জন নিহত ও ৩৩৫ জন আহত হয়।
একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চের চার তারিখ ছিল দেশব্যাপী লাগাতার হরতালের তৃতীয় দিন। তবে ওই দিন হরতাল ছিল আট ঘণ্টার। দ্রোহ-ক্ষোভে বঞ্চিত শোষিত বাঙালি তখন ক্রমেই ফুঁসে উঠছিল ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে বসে ছিল না কুখ্যাত পাকিস্তানি বাহিনী। কার্ফু দিয়েও সামরিক জান্তারা সাহসী বীর বাঙালিদের ঘরে আটকে রাখতে না পেরে গোপনে আঁটতে থাকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে বাঙালি নিধনের হীন পরিকল্পনা। বাঙালি মুক্তিকামি জনতা শুধু অপেক্ষা করতে থাকে ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কী বলেন, তা শোনার জন্য। আন্দোলনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা দফায় দফায় বৈঠকে বসেন ৭ মার্চের জনসভা সফল করার জন্য। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহ্াওয়ার্দী উদ্যান) চলতে থাকে জনসভার প্রস্তুতি। পাশাপাশি ঢাকাসহ সারাদেশেই গঠন হতে থাকে সংগ্রাম কমিটি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যুব ও ছাত্র নেতারা গোপনে নানা স্থান থেকে অস্ত্র সংগ্রহ অভিযান চালাতে থাকেন বেশ জোরেশোরেই। একাত্তরের ওই দিনে বাঙালির মিছিলে মিছিলে ঝাঁঝাল সেøাগানে উচ্চারিত ছিল সারাদেশ। প্রধান সেøাগান ছিল- ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্ম-মেঘনা-যমুনা, তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগে উদ্যোগে একাত্তরের উত্তাল, ঝঞ্ঝাবিব্ধু ওই দিনটিতে সারাদেশের সকল পাড়া, গ্রাম, মহল্লায় সংগ্রাম কমিটির পাশাপাশি শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলের (বর্তমান সার্জেন্ট জহুররুল হক হল) ক্যান্টিনে স্থাপন করা হয় ছাত্রদের যোগাযোগ কেন্দ্র।
মুক্তিকামী জনতার স্বাধীনতা আদায়ের প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলে দেশজোড়ে। ছাত্র সমাজেরা এদিন স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে বড় তৎপর থাকেন। আপামর জনতারা ফেটে পড়েন স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামে।
এ রকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ডাকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ায় এদিন এক বিবৃতিতে তিনি দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে স্বাধীকার আদায়ের লক্ষ্যে জনগণকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বলেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে আওয়ামী লীগের এক মুলতবি সভায় ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে সংগ্রামের নতুন দিক নির্দেশনায় বলেন, আজ আওয়ামী লীগ নয় গোটা বাঙালি জাতিই অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন। আমাদের সামনে আজ দুটো পথ খোলা আছে। একটি সর্বাত্মক ত্যাগ স্বীকারের জন্য নিজেদের মনোবল অটুট রেখে অবিচলভাবে পূর্ণ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়া অথবা ভুট্টো ইয়াহিয়ার কথামতো সবকিছু মেনে নেয়া। তিনি নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে বলেন, আপনারা জানেন, আমি সারা জীবন ক্ষমতার মসনদ তুচ্ছ জ্ঞান করে দেশ ও জাতির কাছে আমার জীবন মর্টগেজ রেখেছি। বাংলার মানুষ গুলি খেয়ে বন্দুকের নলের কাছে বুক পেতে দিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে আমাকে মুক্ত করে এনেছে। আমার ৬ দফা কর্মসূচির প্রতি ম্যান্ডেট দিয়েছে। এখন শহীদের আত্মত্যাগের প্রতি অশ্রদ্ধা জানিয়ে পাকিস্তানিদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে অবমাননাকর শর্তে কী করে ক্ষমতায় যাই।
বঙ্গবন্ধু হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আর যদি এক ফোটা রক্ত ঝরে, বাংলার মানুষকে হত্যা করা হয়, তবে সব দায়দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে। তিনি বলেন, বাংলার মানুষকে হত্যা করে স্বাধিকার আন্দোলন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। তাই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের মধ্যে সারাদেশে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের কাঠামো তৈরির নির্দেশ প্রদান করেন।
এদিকে দেশব্যাপী লাগাতার মানুষ হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের মানুষ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে শেখ মুজিবুর রহামানের ঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।
৪ মার্চ মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আপোসের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে ঘোষণা করে বলেন, ‘৭কোটি বাঙালিকে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সার্বভৌমত্ব অজর্নে বাধা দিলে বীর বাঙালি চূড়ান্ত সংগ্রামে অবর্তীন হবে। তাই স্বৈরাচার পাকিস্তানিদের বাঙালির স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ফলাফল মোটেও ভাল হবেনা।’
এক বিবৃতিতে লাহোর প্রস্তাাবের ভিত্তিতে সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের দাবি জানান। বিবৃতিতে তিনি বলেন, কংগ্রেস, খেলাফত, মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের মাধ্যমে আন্দোলন করেছি। কিন্তু এই ৮৯ বছর বয়সে এবারকার মতো গণজাগরণ ও সরকারের অগণতান্ত্রিক ঘোষণার বিরুদ্ধে এমন সংঘবদ্ধ বিক্ষোভ আর দেখিনি।
একাত্তরের এদিনে স্বাধীনতা আদায়ের সংগ্রামে উত্তালে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিকামী এদেশের সব শ্রেণির পেশাজীবী মানুষ। বাঙালিরা পাকিস্তানি স্বৈরাচারদের শোষনের নির্যাতন হতে চাইনা। বাঙালিরা চায় নিজেদের স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচার অধিকার। চায় মুক্তির অধিকার। এসব সেøাগানে এদিন রাজধানীর জনপথ মূখরিত হতে থাকে। অপরদিকে, এদিন পদচ্যুত গর্ভনর ভাইস এ্যাডমিরেল এস.এম. আহসান বিমান যোগে করাচীর উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন। একই দিনে অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে ছিলেন।
আগের দিনের বিহারী-বাঙালি সংঘর্ষের রেশ ঢাকাসহ সারা দেশে বিরাজ করছিল। থমথমে পরিণত হয় পুরো পরিবেশ। এর মাঝে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দেশব্যাপী তা-ব ও হত্যার প্রতিবাদে ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল ও নিহতদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সকাল এগারোটায় লালদীঘিতে পাহাড়তলীতে শহীদ হওয়া বাঙালিদের গায়েবী জানাজা পড়া হয়। হাজার হাজার মানুষ এ জানাজায় অংশগ্রহণ করে। জানাযার পর পাহাড়তলীতে শহীদ হওয়া কয়েকজন বাঙালির রক্তমাখা কাপড় নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে জানাজায় অংশগ্রহণকারী মানুষরা। মৌলভী সৈয়দ আহমেদ আরেকটি আইয়ামে জাহিলিয়াতের যুগ এসেছে বলে রক্তমাখা কাপড়গুলো জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। বিকালে আওয়ামী লীগ নেতারা পুলিশী প্রহরায় পাহাড়তলীর ওয়ারলেসে ক্ষতিগ্রস্থ বাঙালিদের দেখতে যান। রাতে, বিহারীরা বেশ কয়েক জায়গায় বাঙালিদের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। হালিশহরে আর্মি ক্যা¤েপর কাছে ছয়-সাতজন বাঙালিকে সবার সামনে জবাই করে বিহারীরা।
এদিন প্রবীণ সাহিত্যিক-রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদের আহ্বানে পাকিস্তান সরকারের দেয়া খেতাব ও তকমা বর্জন করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, মুনীর চৌধুরী, শিক্ষাবিদ ইব্রাহীম খাঁ, কবি আহসান হাবীব, কথাশিল্পী জয়েনউদ্দিনসহ অনেকেই।
সাংবাদিকরা পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের তথ্য দৃঢ়তার সঙ্গে সংগ্রহ করে মুক্তিকামী বাঙালিদের নিকট তা অবহিত করেন। যাতে করে বাঙালিরা ষড়যন্ত্রকারী পাকিস্তানিদের সর্ম্পকে আগে থেকেই সতর্কতা অবলম্বনের সুযোগ পেয়ে থাকেন। বাঙালিরা সব ষড়যন্ত্রকে দৃঢ়তার সঙ্গে যেভাবে মোকাবেলা করা যায় সেই প্রস্তুতি নিতে পারেন।
পাকিস্তানিদের নির্যাতন এবং বাঙালিদের স্বাধীকার আদায়ের দৃঢ় সংকল্পের খবর পরদিন ৫ই মার্চ বিভিন্ন দৈনিক পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে গুরুত্বর সঙ্গে প্রকাশ পায়। ফলে ওই প্রকাশিত খবর গুলো পড়ে পাকিস্তানিরা দূর্বল হয়ে যায়। অপরদিকে. স্বাধীকার আন্দোলনে মুক্তিপাগল বাঙালিরা তৎপর হয়ে ওঠেন।
(লেখক : এম. কে. দোলন বিশ্বাস, দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক)