দিনাজপুরের পার্বতীপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ৬০৪ জন শ্রমিক স্বাস্থ্য বিধির নামে করোনাকালীন দীর্ঘ প্রায় ৭ মাস খনি অভ্যন্তরে অবরুদ্ধ থাকার পর প্রধান ফটক খুলে বের হয়ে এসেছে। গত রোববার রাত সোয়া ৮ টার দিকে একযোগে সকল শ্রমিক বিদ্রোহ করে খনি থেকে বের হয়ে আসেন। এর ফলে খনির কয়লা উৎপাদন প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কয়লা উৎপাদন কাজে নিয়োজিত চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এক্সএমসি-সিএমসি কনসোর্টিয়াম চীনা শ্রমিক দিয়ে খনি রক্ষণাবেক্ষণসহ কোন রকমে এক শিফটে কয়লা উত্তোলন করছে। তবে, সোমবার বিকেল ৪ টার দিকে আন্দোলনকারী ১১৮ জন শ্রমিক কাজে যোগদান করেছেন। বৈশ্বিক করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে লকডাউনের কারণে গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে যায় খনির কয়লা উৎপাদন।
এ ঘটনায় গত রোববার রাত সাড়ে ১২টায় পার্বতীপুর মডেল থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) সৈয়দ ইমাম হাসান ২৩ খনি শ্রমিকের নামসহ অজ্ঞাত সংখ্যক শ্রমিককে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছে। পার্বতীপুর মডেল থানা পুলিশ সোমবার ভোরে খনি গেটের সামনে থেকে ইব্রাহিম আলী (৪৫) রবিউল সরকার (৩৯), আসাদুজ্জামান জীবন (৩৩) ও মহিবুল ইসলাম ডালিম (৪৩) নামে ৪ শ্রমিককে গ্রেফতার করেছে। গ্রেপ্তারকৃত শ্রমিকদের সোমবার বিকেল ৫টার দিকে আদালতের মাধ্যমে দিনাজপুর জেলহাতে পাঠিয়েছে পুলিশ।
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সাধারন সম্পাদক নুর ইসলাম বলেন- গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর কয়লা খনির তালিকাভুক্ত ১ হাজার ১৪৩ জন শ্রমিকের মধ্যে কোভিড-১৯ পরীক্ষার মাধ্যমে ৬০৪ জন শ্রমিককে খনিতে প্রবেশ করানো হয়। দীর্ঘ ৭ মাস ধরে এসব শ্রমিককে ৩টি ছোট কক্ষে গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য করা হয়। এসকল শ্রমিকসহ আউটসোর্সিং এর অধীনে প্রায় ২৫২ জন কর্মচারীকেও খনি কম্পাউন্ড থেকে বের হতো না। পাশর্^বর্তী মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনিতে শ্রমিকরা অবাধ চলাচলের অনুমতি পেলেও বড়পুকুরিয়ায় নেই।
মেকানিক্যাল শ্রমিক রাহেনুল ইসলাম জানান, মায়ের মৃত্যু জন্য বাড়ীতে গেলে আর কাজে যোগদান করতে দেয়নি। শ্রমিক মোঃ আনোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন, সম্প্রতি তার মায়ের মৃত্যু হলেও কর্তৃপক্ষ তাকে খনি থেকে বের হতে দেয়নি। খনি শ্রমিক আবদুর রহিম অভিযোগ করে বলেন, ৭ মাস আগে যখন আমি কাজে যোগ দিতে আসি সে সময় বাড়িতে ৩ মাস বয়সের একটি কন্যাসন্তান রেখে আসি। এখন তার বয়স ১০ মাস। বাড়িতে গেলে সে আমাকে অপরিচিত মনে করে কাছেই ভিড়ছে না, এটা খুবই বেদনাদায়ক। তিনি আরও বলেন, কোভিড-১৯ স্বাস্থ্য বিধির নামে "গত ৭ মাস ধরে আমি বাথরুমে ছিলাম। আমরা খনি থেকে বেরিয়ে এসেছি কারণ সেখানে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছিল।
এছাড়া চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কারণে অকারণে দেশীয় শ্রমিকদের জরিমানাসহ নানাভাবে হয়রানি করে আসছিল। পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে পড়ায় শ্রমিকরা বাহিরে আসার দাবিতে গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে খনির ভিতরে বিক্ষোভ শুরু করে। এ ছাড়া প্রায় এক বছর ধরে বেকার হয়ে পড়া শ্রমিকরা খনির বাইরে বিক্ষোভ মিছিল করে কাজে যোগদানের দাবী জানায়।
এদিকে, সোমবার সকাল সাড়ে ১১টায় শ্রমিকরা ৪ দফাদাবী নিয়ে ফুলবাড়ী প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করেন। সম্মেলন শেষে খনি শ্রমিক ফুলবাড়ী শহরে বিক্ষোভ মিছিল প্রদক্ষিণ করেন।
গত রোববার দুপুরে দিনাজপুর জেলা প্রশাসক খালেদ মোহাম্মদ জাকি, পার্বতীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাশিদ কায়সার রিয়াদ অচলাবস্থা নিরসনের জন্য খনি কর্তৃপক্ষ এবং আন্দোলনকারী খনি শ্রমিকদের নিয়ে আলোচনা বৈঠক করে। ৪ ঘণ্টা ব্যাপী অনুষ্ঠিত বৈঠক কোন সমঝোতা ছাড়াই শেষ হয়। পরে রাত সোয় ৮ টার দিকে শ্রমিকরা একযোগে খনির মেইন গেট খুলে বাহির হয়ে আসে। খনি নিরাপত্তায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সোমবার দিনাজপুর পুলিশ সুপার মোঃ আনোয়ার হোসেন এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
পার্বতীপুর মডেল থানার কর্মকর্তা ইনচার্জ (ওসি) মোঃ মোখলেছুর রহমান জানান- বড়পুকুরিয়া খনির ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) সৈয়দ ইমাম হাসান বাদি হয়ে ২৩ খনি শ্রমিকের নামসহ অজ্ঞাত সংখ্যক শ্রমিককে আসামি করে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়ের করেছে। পুলিশ ইব্রাহিম আলী (৪৫) রবিউল সরকার (৩৯), আসাদুজ্জামান জীবণ (৩৩) ও মহিবুল ইসলাম ডালিম (৪৩) নামে ৪ শ্রমিককে গ্রেফতার করেছে।
এব্যাপারে সোমবার সন্ধ্যায় ৬টার দিকে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামানের সাথে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা ও খুদে বার্তা পাঠিয়েও তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ তার বক্তব্য য়ো সম্ভব হয়নি।