বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়। স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তী পালন করছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীও পালন করছেন সবাই। এমন এক সন্ধিক্ষনে শাসক দল আওয়ামীলীগ তাদের দলে অনুপ্রবেশ নিয়ে দারুন ভাবে চিন্তিত। বারবার দলে অনুপ্রবেশ ঠেকানোর কথা বলা হলেও বন্ধ হচ্ছে না কোনো ভাবেই। স্বয়ং দলের সভানেত্রী ও প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা নিজ উদ্যোগে তৈরী করে তৃনমূল পর্যন্ত ব্যবস্থা নিতে বলেও কার্যকর কোনো ফল পাওয়া যায় নি। স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্ত্রী উপলক্ষে এখন প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসেবে গড়মিল হচ্ছে। তাই পর্যবেক্ষণ মহল বলছে, মানুষ আজ ভোগবাদী, ত্যাগের স্পৃহা উধাও, দেখতে হচ্ছে জনগনের সম্পদ লুন্ঠন, অসহায়ের সম্পত্তির জোর দখল, রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতা, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানের বিস্তার, বাঙালির আত্মপ্রচারনা ও খ্যাতির মোহের প্রত্যাবর্তন দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকায় এক শ্রেণীর ধান্দাবাজ মানুষ নীতি আদর্শের কথা না ভেবে নিজেদের আখের গোটাতে দলে দলে যোগ দিয়ে সরকারের সব অর্জনকে বিসর্জন দিয়ে ম্লান করে দিচ্ছেন। অথচ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল। স্বাধীনতা সংগ্রাম ছাড়াও দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এ দলের নেতা-কর্মীরা নানা জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন। দু:সময়ে দলের জন্য কাজ করেছেন, তারা আজ দলে অবহেলিত।
সম্প্রতি গনমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে ফরিদপুরের দুই ভাই আড়াই হাজার কোটি টাকা মানি লন্ডারিং করেছেন। এজন্য ১০ জনকে আসামী করে মামলাও হয়েছে। লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে এ মামলার তিন নম্বর আসামী খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর কখনো আওয়ামী লীগ করেন নি। তিনি সাবেক মন্ত্রী ও ফরিদপুর-৩ আসনের সংসদ খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাই। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুসারে ২০০৯ সালে খন্দকার মোশাররফ মন্ত্রী হবার পর তিনি ফরিদপুর নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে ভাইয়ের পক্ষে না থেকে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে তিনি তার ৫০ সিসির মটর বাইক নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এখন পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগ যোগ না দিলেও তাকে কমিশন না দিয়ে কেউ কোনো কাজ ফরিদপুরে করতে পারে না। অন্যদিকে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের ৪ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম সভায় যুগ্ম সাধারন সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ সবাইকে চমকে দিয়ে জানিয়েছেন কার্যনির্বাহী কমিটির ৮ নম্বর সদস্য হিসেবে যিনি রয়েছে তার নাম মো: আবদুল আজিম জুনেল। তিনি দু:সময়ে আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিএনপিতে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু এরপর তিনি আর বিএনপিতে ফিরে আসেন নি। ২০০৩ সালে যখন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের হামলা-মামলায় আওয়ামী লীগ নেতারা জর্জরিত, তখন শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহমুদ হোসেন মঞ্জুর সাথে বিএনপিতে যোগ দেন আবদুল আজিম জুনেল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও সংগঠনে ফেরেন নি তিনি। পুনরায় আওয়ামী লীগে যোগদানেরও রেকর্ড নেই। তাই আওয়ামলী লীগের কমিটিতে স্থান পেলেন মুজিব আদর্শের সৈনিক হিসেবে তাকে অভিনন্দন জানানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই ৭৫ সদস্যের মহানগর কমিটির ৭৪ জনকে অভিনন্দন জানালেও ১ জনকে অভিনন্দন জানাননি তিনি। অন্যদিকে আবদুল আজিম জুনেল বলেন, ওয়ার্ড পর্যায় থেকে রাজনীতি করে তিনি শহর আওয়ামীলীগের দফতর সম্পাদক হন। পরে মহানগর আওয়ামীলীগের প্রথম কমিটিতে তাকে সদস্য করা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় কমিটিতে তাকে বাদ দেয়া হয়। ফলে তিনি রাজীনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তবে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। ভুল তথ্যের ভিত্তিতে তার দিকে এমন অভিযোগ করা হচ্ছে। তিনি শাহীদ পরিবারের সন্তান। তিনি কখনো বিএনপিতে যোগ দেন নি। যথাযথ সুষ্ঠ তদন্ত ছাড়া এ ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যাবেনা। তবে বলা যায় ঘরে চেলে ঘরেই ফিরেছে। একথা তো সত্য বিএনপি, জাতীয় পার্টি ঘুরে এখন আওয়ামী লীগের টিকেটে সাংসদ হয়েছেন তিন ডজন নেতা। আর অভিযোগ রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা পিস কমিটি, রাজাকার আলবদর ছিলেন তাদের পরিবারের অনেকে আওয়ামীলীগ করেন এবং বেশ প্রভাবশালী।
আসলে সরকারি দলে অনুপ্রেবেশের ঘটনা সব সময়ই ছিল, আছে, থাকবে। তবে সেই অনুপ্রেবেশ যদি পুরো দলকে গ্রাস করে ফেলে তখন নিবেদিত নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পরেন। মূলত: আওয়ামী লীগে ২০০৮ সালে অনুপ্রবেশ শুরু হয়। ২০১৪ সালের পর ঢালাওভাবে অনুপ্রবেশ ঘটে। দলের সাধারন সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অনুপ্রেবশকারীদের কাউয়া বলে আক্ষ্যায়িত করেছেন। অনুপ্রবেশকারীদের মিছিলের মাঝেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। উপজেলা নির্বাচনে নৌকার বিরোধীতা করায় শৃংঙ্খলা ভংঙ্গের অভিযোগে শাস্তি দিতে গত এপ্রিলে একটি তালিকা করে আওয়ামী লীগ। নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে ১৪০ উপজেলায় জয় পান দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা। আর এই বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রশ্রয় দেওয়ায় অভিযেগা ওঠে অনেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদের বিরুদ্ধে। দলের বিরুদ্ধে নির্বাচন ১৭৭ জন বিদ্রোহী প্রার্থীকে গত সেপ্টেম্বরে কারন দর্শনোর নোটিশ পাঠিয়েছিলো কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। অবশ্য তাদের দেওয়া জবারের ভিত্তিতে অক্টোবর মাসে তাদের সাধারন ক্ষমার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর পর থেকে দলীয় সিদ্ধান্ত না মানলে তাকে আর কখনো কোন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হবে না বলে বাবরার হুশিয়ারি দেয়া হলেও পৌর সভা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীরা জিতেছেন। আসছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এখানেও মন্ত্রী, সাংসদরা তাদের নিজেদের লোকজনকে মনোনয়ন দিলে তৎপর হয়ে উঠেছেন। এর বাইরে যারা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে মনে করছেন, তাদেরকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে তারা ইতোমধ্যেই প্রচারনা শুরু করে দিয়েছেন। ফলে হাইব্রিড ও জনবিচ্ছিন্ন প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নৌকা ডোবাচ্ছেন।
গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ জাতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত রাখার কথা শোনা গিয়েছিলো। এর অংশ হিসেবে জেলা, উপজেলা, ওয়ার্ড এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে যারা বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারী, তারা যাতে ভবিষ্যতে দলের কোন পদ না পান সেটি নিশ্চিত করতে কেন্দ্র থেকে আওয়ামীলীগের মাঠ পর্যায়ে চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দূর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, জঙ্গিবাদ, ভূমি দখলকারী অপকর্মের সাথে জড়িত ব্যক্তিরাই দলের পদগুলো দখল করতে সক্ষম হন। অনুপ্রবেশকারীদের শ্রোত ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে উদ্যোগ নেয়ার কথা বারবার বলেও কার্যকর করতে পারেন নি। অবশেষে নিজ উদ্যোগে সারা দেশে পাঁচ হাজার অনুপ্রেবশারীর তালিকা তৃনমূলে পাঠান। কিন্তু অবস্থা যা ছিল তাই রইলো।
সাংসদরা স্বজনপ্রীতির বসবর্তি হয়ে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনকে মাঠ পর্যায়ে নেতৃত্ব দেবার সুযোগ করে দেন। সেখানে নিবেদিত আদর্শবাদী নেতা-কর্মীরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতেই নাভিশ^াস হয়ে ওঠেন। সেখানে কে রাজাকার কে বিএনপি এসব পরখ করার সময় কোথায়? অন্যদিকে যারা বিএনপি, জাতীয় পার্টি হয়ে নৌকায় উঠেছিল, তারা তো নৌকা চালাতে তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনার মানুষকেই চাইবেন। ফলে নিবেদিত নেতারা বঞ্চিত হন স্থানীয় পদ-পদবী থেকে। তাই হাইব্রিড জনবিচ্ছিন্ন নেতারা সবখানে তাদের বিজয় ডংকা বাজাচ্ছেন। আর বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনের দু:খে বলছেন, এতো আওয়ামী লীগ কোত্থেকে এলো? কোথায় ছিলেন তারা যখন বঙ্গবন্ধুর লাশ অবহেলায় ৩২ নম্বরে পড়ে ছিলো? ফলে আদর্শবান ত্যাগি দলীয় নেতা-কর্মীদের দ্বীর্ঘশ^াস ফেলা ছাড়া কিছুই করার নেই।