পৃথিবীতে করোনার অতিমারি চলছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষের প্রাণ নিয়েছে এই ভাইরাস। আক্রান্ত কোটি কোটি। প্রতিদিন মানুষ মরছে। কোনো কোনো দেশে ভাইরাস ফের তান্ডব শুরু করেছে। বাংলাদেশেও আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশার কথা হলো এখন ভ্যাকসিনের প্রয়োগ চলছে। তবে কেবল ভ্যাকসিন নিয়েই নিশ্চিন্তে বসে থাকার সুযোগ নেই। মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। করোনার শুরু থেকেই স্বাস্থ্যবিধির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে বিশ^জুড়েই। এখনও তাই করা হচ্ছে। কিন্তু এই স্বাস্থ্যবিধি যাদের মেনে চলার কথা সেই সাধারণ মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা একেবারেই কম। এখন তো প্রায় নেই বললেই চলে! অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা। করোনা ভাইরাস মানুষের মাঝে যে আতংকের সৃষ্টি করেছে তা থেকে মানুষ স্বাস্থ্যবিধিতে পাকাপাকিভাবে অভ্যস্থ হওয়ার কথা ছিল। যে অভ্যাস মানুষ পালন করতো করোনা ভাইরাস চলে গেলেও। অথচ ঘটছে তার উল্টোটা। বারবার বলা হচ্ছে যে ভ্যাকসিন গ্রহণ করলেও করোনার স্বাস্থ্যবিধি ঠিকঠাক মেনেই চলতে হবে, তা সত্ত্বেও এই অসচেতনতার পরিণতি আমাদের দেশে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শীত পেরিয়ে এখন গরম। গত বছর এই সময়েই করোনার তান্ডব ক্রমেই শুরু হয়েছিল। আমাদের সেই দুঃসময় ভুলে গেলে চলবে না। প্রথম দিকে সংক্রমণ ঠেকাতে দেশগুলো লকডাউনের পথে হেঁটেছিল। তারপর অবশ্য জীবিকার কারণে স্থবির অর্থনীতি সচল করার জন্য সবকিছু খুলে দেওয়া হয়। তারপর থেকেই এভাবে চলছে। করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রচেষ্টায় ছিল সারা পৃথিবী। সেই প্রচেষ্টায় সফলও হয়েছে। সারা বিশে^ কয়েকটি ভ্যাকসিনে প্রয়োগ চলছে। এসেছে এক ডোজের ভ্যাকসিনও। তবে সব কিছুর ওপরে সেই স্বাস্থ্যবিধি। বিশেষ করে মাস্ক ব্যবহার করা, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা, হাত বারবার সাবান দিয়ে পরিষ্কার করা, হ্যান্ডশেক বা কোলাকুলি থেকে বিরত থাকা বা সংস্পর্শে না আসা, হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে দেয়া, কাপড় চোপড়সহ সবকিছু জীবাণুমুক্ত রাখা ইত্যাদি সহ আরো বেশকিছু নিয়ম কানুন। এসব করার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা। তা সত্ত্বেও প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে। প্রথম দফা সংক্রমণ শেষে কোনো দেশে দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ হয়েছে। যখন মনে হচ্ছে করোনা ভাইরাস বিদায় নিয়েছে তখন নতুন কোনো রোগী পাওয়া যাচ্ছে।
এই সময়টাতে আমাদের সামাজিক দুরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি মেনা চলা একান্ত প্রয়োজন। স্বাস্থ্যবিধি এমন একটি বিষয় যা আমাদের প্রতিদিন মেনে চলা উচিত। এটা ছোট থেকে বড় সবার মেনে চলা উচিত। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার মতো নিত্য স্বাস্থ্যবিধি আমাদের এমনিতেই অনুসরণ করা উচিত। এর ফলে আমরা বহু রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারি। কিন্তু আমরা তা কতজন করি? নিজের সুরক্ষায় করোনা ভাইরাসের প্রকোপ শুরুর প্রথম থেকেই এ কথাই বলা হচ্ছে। কিন্তু এখন হাট বাজারে সবর্ত্র পরিস্থিতি দেখে মনে হয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তেমন কোনো আগ্রহ আমাদের মাঝে নেই। মাস্ক ব্যবহারেই চূড়ান্ত অনীহা দেখা যাচ্ছে। এর জন্য জরিমানাও করা হয়েছে। অথচ এটার জন্য কোনো আইনের দরকার ছিল না। সবার নিজের থেকেই মাস্ক পরার উচিত ছিল। কারণ সুরক্ষা তো কেবল নিজের নয় বরং এর সাথে পরিবারের সুরক্ষাও জড়িয়ে রয়েছে। তবে আমাদের কারো ভেতর সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। অবশ্য আইন মেনে চলার ক্ষেত্রে আমাদের উদাসীনতা বরাবরই নিজেদেরই দুর্ভোগের কারণ হয়েছে।
অর্থনীতিকে সচল রাখতে, জীবকার কল্যাণে মানুষ কাজে ফিরেছে। নিয়মিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই একমাত্র সংক্রমণ ঠেকানোর কার্যকর ভরসা। সেই ভরসা যারা বাস্তবায়ন করবে তারা সাধারণ জনগণ। আইন না মানলে তার জন্য শাস্তি দেওয়া হবে কিন্তু এভাবে আইনের মাধ্যমে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অভ্যাস করানোর চেয়ে তাদের সচেতনের মাধ্যমে হলে তা সহজতর হবে। কারণ আমাদের দেশে জনকল্যাণে বহু আইন রয়েছে। কিন্তু সেসব বহু আইনের মেনে চলার প্রবণতা নেই। একটু মেনে চললেই যখন দেশটাকে আরো সুন্দর করে তোলা যায় কিন্তু আমরা তা করতে নারাজ। আর করোনার সময়ে মেনে চলা আবশ্যকীয় স্বাস্থ্যবিধি নিজের জীবনের প্রশ্ন। নিজের সাথে আরো অনেক মানুষের জীবনের প্রশ্ন। কারণ একজন থেকে অনেকে ছড়ায় এই ভাইরাস। অথচ সামান্য একটু অভ্যাস পরিবর্তন করলেই আমরা নিজেদের সুরক্ষিত করার পাশাপাশি অন্যদেরও সুরক্ষিত রাখতে পারি। করোনা মহামারীর শুরুর পর থেকে সবাইকে মাস্ক ব্যবহার করা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা,বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এসব স্বাস্থ্যবিধির অনুশীলন করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এখনো তাই বলা হচ্ছে। কারণ প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে এবং আক্রান্তও হচ্ছে। কতদিনে ভ্যাকসিন আমাদের দেশে আসবে ততদিন আরও প্রাণহানি ঘটবে। যদি আমরা সবাই চাই তাহলে এই প্রাণহানি এবং আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারি। এটা করা সম্ভব কেবল স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে অনুসরণ করলে। কিন্তু আমাদের সেই চিরাচরিত জীবন যাপন আমরা আজও ছাড়তে পারিনি। এই করোনার সময়েও আমরা প্রায়ই স্বাস্থ্যবিধি মানতে অস্বিকার করছি। করোনা শুরুর পর কিছুটা নিয়মের মধ্যে জীবন যাপন করলেও দিন গড়ানোর সাথে সাথে আমাদের মধ্যে থেকে সেই প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে। যা আমাদের দেশের জন্য আশংকাজনক। এতে কোনোভাবেই ভালো হবে না। করোনা নিয়ন্ত্রণের যে প্রচেষ্টা তা সফল ভাবে সম্ভব হবে না। কারণ এর অনেকটা দায় আমাদের ওপরেও বর্তায়।
আমরা নিজেদের দায়িত্ব কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারি না। রাস্তাঘাটে,গণপরিবহণে,হাট বাজারে মানুষের চলাচল দেখে বুঝতে কষ্ট হয় যে পৃথিবীতে করোনার অতিমারী চলছে এবং আমাদের দেশে এই অতিমারীতে প্রতিদিন প্রাণহানি ঘটছে। সবকিছু খুললেও দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনও বন্ধ রয়েছে। বহুদিন পার হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া প্রয়োজন। নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধি দুশ্চিন্তার কারণ। যদিও দেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম চলছে। তারপরও যথাসম্ভব যার যার জায়গা থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। আমাদের চিত্র প্রকৃতপক্ষে বিপরীত। সংক্রমণ উর্ধ¦মুখী হলেও সাস্থ্য সচেতনতা নিন্মমুখী। হয়তো করোনা ভাইরাসের বিষয়টিই আমরা ভুলতে বসেছি। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে এখনো দেশে করোনা আক্রান্ত হচ্ছে, মৃত্যু হচ্ছে এবং সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলাচল করা আমাদের নিজের জন্য এবং অন্যের জন্য হুমকি হতে পারে। একটি প্রাণও তো মহামূল্যবান। একমাত্র সচেতনাই পারে এর থেকে রক্ষা করতে। আর উদাসীনতা পারে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যেতে। আমাদের করোনার প্রতি এই গা ছাড়া ভাব থাকলে করোনা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বেশি মারাত্বক। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সবার মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। এটা আমাদের উপলদ্ধি করতে হবে।
অলোক আচার্য
সাংবাদিক ও কলাম লেখক