সেই আশির দশকের কথা। দোয়াল্লিন-জোয়াল্লিন, ক্বিয়াম-লাক্বিয়াম, হাজির-নাজির, কদমবুছিসহ আরও বিভিন্ন বিষয়আশয় নিয়ে ক্বওমী ও আলিয়াপন্থী কিংবা সুন্নী ও ওয়াহাবীদের মধ্যে লাগালাগি ঘষাঘষি কিংবা ফিতনা ফ্যাসাদ লেগেই থাকতো। কিশোর বয়সে এসব নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় মুনাজেরা বাহাস বিতর্ক সেসাথে মারামারি হানাহানির খবর শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। আমার প্রাইমারী স্কুল থেকে পাঠশালা শেষ করে রামসুন্দর হাই স্কুলে কিছুদিন পড়ে আলিয়া মাদরাসায় মাধ্যমিক স্থরে লেখাপড়া চলছিলো তখন। তখনকার সময়ে ওয়াজ মাহফিল ছিলো অনেকটা মাদরাসাকেন্দ্রীক। প্রায় প্রতিটি মাদরাসায়ই বছরে দুটি ওয়াজের আয়োজন করা হতো। একটিকে বলা হতো কাত্তিমাইয়া বা ছয়মাইয়া ওয়াজ। অপরটিকে বলা হতো ফাল্গুণ মাইয়া বা বছরী ওয়াজ। ওয়াজের দান খয়রাত চাউল বাঁশ লিল্লার এবং চান্দার আয় দিয়ে মাদরাসাগুলোর বহুত কাম কাজ চালানো হতো।
ক্বওমী ও আলিয়া উভয় মসলকে তখনও বেশিরভাগ উলামায়ে কেরাম ছিলেন লিওয়াজহিল্লাহ খালিস নিয়তে ইসলামের প্রচার ও প্রসারকাজে মশগুল। ছিলেন আল্লাহওয়ালা ও চলনে বলনে সাদাসিদে। বর্তমান সময়ের মতো কোথাও কোথাও লাখ লাখ টাকার চুক্তি করে মার্কা মারা কমেডিয়ান অভিনয়ে পটু ওয়াইজ আনার প্রচলণ তেমন একটা শুনা যেতোনা তখন।
তখন সিলেটের বাইরের কিছু গরম সুন্নী কথিত মাওলানার অনুপ্রবেশ ঘটে সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে। তারা বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে তারা বাদে বা তারা এবং তাদের অনুসারী ছাড়া প্রায় সকল ওলামায়ে কেরামদের গালাগালি করতে থাকেন ঢালাওভাবে। ক্বওমী ও ওহাবী শব্দগুলো অনেকে গালি মনে করতেন। তারা বিভিন্ন দলিলাদি পরিবেশন করে ক্বওমী ও ওহাবীদের কাফির ফতোয়া দিতে দ্বিধা করতেননা। যারা ওদেরকে কাফির বলবেনা তারাও কাফির বলে জোর গলায় ঘোষনা দিতেন এসব মাহফিলে বয়ানের সময়। ওদের পিছনে নামাজ পড়া হারাম। ওদের মেয়ে বিয়ে করা বা ওদের ছেলের সাথে নিজের মেয়েও বিয়ে দেয়া বা কুটুমিতা করা হারাম এমনকি সালাম কালাম বা সালামের জওয়াব দেয়াও হারাম ফতোয়া দিতেন। সিলেটে কিছু অনুসারী পাওয়ার কয়েকদিন পরেই আলিয়ার মধ্যে অনেকটা উদারপন্থী সিলেটের প্রভাবশালী একটি মসলকের অনুসারীদেরকে যাদের মাধ্যমে তাদের সিলেট আগমন তাদেরকে গোলাবী ওয়াহাবী বলে জোর গলায় প্রচার করতে লাগলেন।
অপরদিকে ক্বওমীর কিছুসংখ্যক ওলামায়ে ক্বেরামও জোয়াল্লিন বা দোয়াদ হরফকে জোয়াদ পড়ার পক্ষে ছিলেন অনড় অবস্থানে। এই স্বল্পসংখ্যক ক্বওমী মাওলানাও দোয়াল্লিন-জোয়াল্লিন, ক্বিয়াম-লাক্বিয়াম, হাজির-নাজির, কদমবুছিসহ আরও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মাঠ গরম করতে দেখা যেতো। আলিয়ায় পড়-য়াদের বেদাতী বলে সম্বোধন করতেন তারা।
তখন সাধারন মুসল্লিদের বেশিরভাগই দুই ধারায় বিভক্ত ছিলেন। একপক্ষ অন্যপক্ষের ওয়াজ মাহফিলে তেমন একটা যেতেন না। কিংবা অন্যপক্ষের অনুসারী অধ্যুষিত মসজিদে গিয়ে জামাতে শরিক হতেও অনেকে অনীহা ব্যক্ত করতে দেখা যেতো। উভয়েই তাদের নিজ নিজ মাদরাসায় পড়-য়া ছাত্রদের এবং তাদের অনুসারীদের এমন বুঝ দিতেন বা ব্রেইন ওয়াশ করে দিতেন, যে তারা পরস্পর পরস্পরকে ঘৃণার চোখে দেখতেই পছন্দ করার একটা রেওয়াজই সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলো। অনেকে পরস্পর পরস্পরকে মুসলমানই মনে করতেননা।
তবে বুজুর্গ বা মুরব্বী উলামায়ে কেরামরা সব সময়ই ছিলেন উদার। তারা কাদা ছুড়াছুড়ি থেকে দুরে থাকতেন।
অনেকে বলতেন আমরা দোয়াল্লিনের পার্টি। আর ওরা জোয়াল্লিনের পার্টি। একবার এক শিক্ষক তাঁর ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন তুই দোয়ালিন না জোয়াল্লিন। উত্তরে বললো দোয়াল্লিন। হুজুর বললেন দোয়াল্লিন হলেও গোমরাহ আর জোয়াল্লিন হলেও গোমরাহ। তাই তুই গোমরাহ পার্টি। পরবর্তীতে বুঝিয়ে দিলেন দোয়াল্লিন শব্দের অর্থই গোমরাহ। আর দোয়াদ হরফকে আরবীরা যেহেতু দোয়াদ উচ্চারণ করেন তাই জোয়াদ উচ্চারণ করাটাও ভুল। তাই জোয়াদ উচ্চারণ যারা করে তারাও গোমরাহ।
সেসময় বিভিন্ন এলাকায় চ্যালেঞ্জ পাল্টা চ্যালেঞ্জ হতো দোয়াল্লিন-জোয়াল্লিন, ক্বিয়াম-লাক্বিয়াম, হাজির-নাজির, কদমবুছিসহ আরও বিভিন্ন বিষয়আশয় নিয়ে। পরস্পরের মধ্যে মুনাজেরা হতো দিন তারিখ ঠিক করে। উভয় পক্ষের মধ্যে দেখা যেত সাজ সাজ রব। কিতাবের ঢেরীসহ মুনাজেরায় উভয়পক্ষ দলে দলে যোগদান করতে শুনা যেতো। কার দলে লোকজন বেশি সেটাও প্রদর্শণের জন্য হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেতেন মসলকিয়ানরা। সাথে থাকতো মারামারি করার প্রস্তুতিও। যারা মুনাজেরায় পারদর্শি ছিলেন তাদেরকে খেতাব দেয়া হতো মুনাজিরে আজম বলে। তাদের কদরও ছিলো অন্যান্যের তুলনায় বেশি। কোথাও কোথাও মারামারি ও হতাহতের ঘটনাও ঘটতো।
আম জনতাকে বিভক্ত করে রাখতে পারলে এবং নিজের দল ভারী করে একটা বলয় গড়তে পারলে লাভ হতো ওই বিভক্তিকারী কথিত আলেমের। ওরাই মাহফিলগুলোতে বাড়তি দাওয়াত পেতেন এবং রুজি রোজগারও হতো ভালো।
বেশ ক’বছর পূর্বে আমি একবার বিশ^নাথ নতুন বাজারে বাসিয়া নদীর উত্তরপাড়ে অবস্থিত জামেয়া মাদানিয়ার মসজিদে নামাজ পড়তে গেলাম। তখন মাদানিয়া মাদরাসা থেকে জামেয়া মুহাম্মদিয়া আরাবিয়া মাদরাসা নামে ওই মাদরাসারই নিকটে উপজেলা পরিষদের পাশের্^ আরেকটি নতুন মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন ছিলো তুমুল উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। উপজেলা পরিষদের মাঠে বিশাল প্রস্তুতি নিয়ে ওই মাদরাসার পক্ষ থেকে প্রথম ওয়াজ মাহফিল চলছিলো সেদিন।
মাদানিয়া মাদরাসার মসজিদের পাশেই মাদরাসার দফতরে ইততেমাম। দেখলাম সেখানে বসে আছেন তৎকালীণ মুহতামিম সাহেব। ওঁর পাশের্^ই মাদানিয়ার দফতরে ঘনিষ্টভাবে বসে গল্প করছেন দক্ষিণ পাড়ের আলিয়া মাদরাসারও তৎকালীণ প্রিন্সিপাল সাহেব। নামাজের জামাত শুরু হতেই দক্ষিণ পাড়ের আলিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল সাহেব উঠে এসে ক্বওমী ইমামের পিছনে নামাজের জামাতে শরিক হয়ে গেলেন। আমি পিছনের কাতারে ওঁর পিছনের কাতারে নামাজ পড়লাম।
দৃশ্যটি দেখে মনে মনে ভাবলাম বড় বড় উলামায়ে কেরামরা একে অপরের পেছনে নামাজ পড়েন, কিন্তু কিছু ভেজালী মুল্লা মৌলভী উল্টাপাল্টা ফতোয়া দিয়ে বিভক্তি বাড়ান, রক্তপাত ঘটান। সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। অযথা কিছু ফেতনাবাজ মৌলভী একে অপরকে কাফির ফতোয়া দিয়ে আম জনতাকে বিভ্রান্ত করে ফায়দা লুটেন আর সমাজে অশান্তি জিইয়ে রাখেন নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য।
আবার কট্টর কওমীপন্থী কতিপয় মাওলানা আলিয়া মাদরাসা বা স্কুল কলেজে বাচ্চাদেরকে পড়ানো ঠিক না বলে ফতোয়া দিতেন। তারা বলতেন সন্তানদেরকে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্ঠির জন্য এবং আখেরাতের ছামানা যোগাড় করার জন্য আরবি উর্দু পড়াতে হবে। বাংলা ইংরেজি পড়া বা পড়ানো দুনিয়া খাওয়ার জন্য। তাই বাংলা ইংরেজি পড়ানো থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করতেন তারা। পরবর্তীতে কওমীর কিছু ছাত্র আলিয়াতে ভর্তি হয়ে মাঝে মধ্যে ক্লাস করা শুরু করেন এবং দাখিল আলিম ফাযিল কামিল পরীক্ষা দিতে থাকলে সেই ফতোয়ার কার্যকারিতা অনেকটা কমতে শুরু করে। বর্তমানে কওমী শিক্ষায় সরকারী স্বীকৃতিও আদায় করেছেন বহু আন্দোলন সংগ্রাম করে। কিছু কিছু সরকারী চাকুরীও করছেন তারা। ভবিষ্যতে সরকারী সকল সেক্টরে আলিম উলামাদের দেখা গেলে ঘুষ দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি অনেকটা কমে আসবে বলে মনে করেন বিজ্ঞজনরা।
বর্তমান সময়ে আলিয়া ও কওমী মাদরাসার উলামায়ে কেরামদের মধ্যে দুরত্ব কমে পারস্পরিক মহব্বত বাড়ছে দিন দিন। খেশি বা কুটুমিতাও করছেন দেদারছে। ছোটখাটো মাসআলা মাসায়িল নিয়ে বর্তমানে তেমন একটা ঝগড়া করতে দেখা যায় না। বিশেষ করে ভেজালী মৌলভীদের কথায় এখন আর আম পাবলিকেরা উঠবস করেননা। তাই একই মঞ্চে কওমী ও আলিয়ার উলামায়ে কেরামদের দেখা যায় বিভিন্ন মাহফিলে। সকল ধরনের লেনাদেনাও চলে পরস্পরের মধ্যে। মৌলিক বিষয়ের উপর যেহেতু কোন বিরোধ নেই তাই ছোটখাটো বিষয়আশয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ জিইয়ে রেখে নিজেরাই দুর্বল হয়ে কোন লাভ নেই। সিলেটের বিশ^নাথের সর্বস্থরের সকল মসলকের উলামায়ে কেরাম মিলে একটি মাহফিল করতে যাচ্ছেন। এটা নিঃসন্দেহে একটা খুশির সংবাদ। অন্যান্য এলাকায়ও এভাবে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একই কাতারে শামিল হলে সাধুবাদ জানাবেন সকলে।।